জার্মানিতে আসার পরে এটাই শাম্মী হকের প্রথম হাসপাতালে আগমন। হাসপাতালের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং পরিপাটি চেহারা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও একবার ডাক্তারের দিকে আরেকবার অনন্য’র দিকে তাকিয়ে দ্বিধা জড়িত কণ্ঠে শাম্মী জবাব দিলো, “কিভাবে যে বলি! ঘটনাটা অনেক লম্বা, আপনি কি আমাকে বেশ কিছুক্ষণ সময় দিতে পারবেন?
অবশ্যই! রোগীদের সেবা করাই আমার দায়িত্ব। রোগের ইতিহাস না জানলে চিকিৎসা দিবো কিভাবে? আপনি শুরু করতে পারেন!
ডাঃ এ্যালানের দরদী কণ্ঠ শুনে আশ্বস্ত হয় শাম্মী হক। আপনি নিশ্চই বাংলাদেশ সম্পর্কে জানেন?
জানি মানে! সেখানে জেফ্রিক নামে আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড আছে।
তাহলে নিশ্চই এটাও জানেন বেশকিছু দিন পূর্বে বাংলাদেশের নাস্তিক এবং অধার্মিক প্রজন্ম শাহবাগে নেমে এসেছিলো। উত্তাল আন্দোলনে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো গোটা দেশ!
হ্যা, কিছুটা জানি, জেফ্রিক আমাকে নিয়মিত শাহবাগের মিছিলের ছবি দিতো। আমি বেশকিছু ভিডিও দেখেছিলাম। তরুণরা পুশির দাবিতে আন্দোলনে নেমে এসেছিলো। আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলোতো; তোমাদের দেশে হঠাৎ পুশির এতো সঙ্কট দেখা দিলো কেন, একেবারে আন্দোলনে নেমে আসতে হলো! তোমাদের টানবাজার, দৌলদিয়া কি এখন নেই? তোমরা জানো কিনা জানিনা, তোমাদের জাহানারা ইমামের আহ্বানে আমি একবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, অনেক পুশি দেখেছি! অনেক! অনেক!
হতভম্ব চোখে শাম্মী অনন্যর দিকে তাকিয়ে রইলো। দু’জনে প্রায় সমস্বরেই বলে উঠলো। স্যার আমরা পুশির দাবিতে মিছিল করিনি, আমরা ফাঁসির দাবিতে মিছিল করেছিলাম।
ওই একই কথা! ডাঃ এ্যালান বলেই যাচ্ছেন, জেফ্রিকের সাথে অনেক দিন কথা হয়না। মানুষটা যে মাঝে মধ্যে কোথায় কোথায় হারিয়ে যায়! আচ্ছা জার্মানিতে আসার আগে জেফ্রিকের সাথে তোমাদের দেখা হয়েছিলো?
না স্যার, জেফ্রিক নামে কাউকে আমরা চিনিনা, জবাব দিলো অনন্য।
সে কি বলো। ওকেতো সবাই চিনে। ওর অবশ্য অন্য একটা নাম আছে ‘বাল’ “ডঃ জেফ্রিক বাল”
চিৎকার করে উঠলো শাম্মী হক! না স্যার আপনি সম্ভবত ভুল করছেন, তার নাম “জেফ্রিক বাল” নয়! আপনি সম্ভবত জাফর ইকবাল স্যারের কথা বলছেন!
ওই হলো। আমার এই এক সমস্যা বুঝলা! আমি নাম ধাম ঠিকমতো মনে রাখতে পারিনা। সে যাই হোক; পুশির কথা কি যেনো বলছিলা।
পুশি না স্যার! আমরা মৌলবাদীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে আন্দোলন করেছিলাম। শাম্মীর কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি!
ও আচ্ছা। তারপর? ডাঃ এ্যালানের চোখে আগ্রহ উঁকি দিচ্ছে।
এমনই এক দিন আমরা শাহবাগ থেকে মিছিল আরম্ভ করলাম “ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই” “জামাত-শিবিরের ঠিকানা এই বাংলায় হবেনা” তারপর কি যে হলো স্যার বুঝলামনা, কে যেনো পেছন থেকে চিৎকার করে উঠলো “ওই শিবির আইলো!” দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে যে যেদিক পারছি ছুটছি! কেউ গিয়ে পড়ছে ফুটপাতের তেলের কড়াইতে, কেউ গিয়ে বাড়ি খাচ্ছে চলন্ত বাসের সাথে, কেউ গিয়ে ধপাস ময়লার ড্রেনে! সে এক ভয়াবহ অবস্থা স্যার, মনে হচ্ছিলো আমরা বুঝি একাত্তরে চলে এসেছি! রাজাকাররা আমাদের ধাওয়া করেছে!
চশমার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি সরু করে জিজ্ঞাসা করলেন ডাঃ এ্যালান, সত্যিই কি জামাত-শিবির ধাওয়া দিয়েছিলো?
না, স্যার! কেউ একজন রাস্তার পাশ থেকে রসিকতা করে ভয় দেখিয়েছে। বাংলাদেশটা আর নাস্তিকদের জন্য রইলোনা স্যার, সব মৌলবাদী হয়ে গেছে! অনন্যর কণ্ঠে ক্ষোভ ঝড়ে পড়ছে।
হ্যাঁ, সেদিন ASS Hip –এর সাথে আমার কথা হয়েছিলো। ছেলেটাও একই কথা বললো! দেশটা নাকি মৌলবাদে ছেয়ে গেছে। মেয়েরা এখন ফ্যাশন করে হিজাব করে। ছেলেরা দল বেধে মসজিদে যায়।
হ্যা স্যার, কথাগুলো সত্যি। কিন্তু স্যার এই ASS Hip – সাহেব’কে তো চিনলাম না! জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে শাম্মী।
সে কি বলো! ASS Hip -কে চিনোনা? ছেলেটাতো তোমাদের মতই মৌলবাদীদের ভয়ে বাংলাদেশ হতে পালিয়ে এসেছে! ওই যে লম্বা চুলের গে ছেলেটা!
ওহ! স্যার! আর্তনাদ করে উঠলো শাম্মী। ওর নাম ASS Hip না! Asif- আসিফ মহিউদ্দিন স্যার!
ওই একটা হলেই হলো। সে যাকগে, তারপরে কি হলো বলো। আমার হাতে সময় কম। একটু সংক্ষেপে হলে ভালো হয়।
তারপরের ঘটনা খুবই করুণ স্যার। ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে অতীতে হারিয়ে যায় শাম্মী, দৌড়ে পালাতে গিয়ে একটা মালবাহী ট্রাকের সাথে ধাক্কা খাই। জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। কোন হাসপাতালে জানেন স্যার? ঐযে মৌলবাদীদের হাসপাতাল ইবনে সিনাতে! প্রথমে অবশ্য সরকারী হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো, মেডিকেল বোর্ড বসেছিলো, ডাক্তাররা সর্বসম্মতিতে বলে দিয়েছে মাথার বেশ কিছু নার্ভ ছিঁড়ে গেছে এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভবনা।
তারপর? উদ্বেগ ঝড়ে পড়ছে ডাঃ এ্যালানের কণ্ঠে।
শেষ পর্যন্ত রিস্কটা নিলো ইবনে সিনার ডাক্তাররা, তারা বললো আমরা একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই। তারা শেষ পর্যন্ত জঘন্য একটা কাজ করেছে স্যার!
কি কাজ?
তারা আমার ছিঁড়ে যাওয়া নার্ভকে কুকুরের নার্ভ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছে।
কি বলো তুমি! উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলেন ডাঃ এ্যালান। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তোমাদের দেশ এতো এগিয়ে গিয়েছে?!
এগিয়ে গিয়েছে বলা যাবেনা স্যার, ঝড়ে বক মরেছে! ইয়া লম্বা দাড়ি ওয়ালা মৌলবাদী ডাক্তার গুলা আর কি পারে! কোন রকমে জোড়া তালি দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে এই আর কি! শাম্মীর কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর।
তুমি কি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ? প্রশ্ন করলেন ডাঃ এ্যালান।
হ্যা, এ ব্যাপারেই একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি স্যার। অপারেশন সাকসেস হলেও নতুন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
কি সমস্যা? আগ্রহ ভরে জানতে চাইলেন ডাঃ এ্যালান। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এই রোগীর প্রতি তার আগ্রহ জন্মেছে।
সমস্যাটা একটু গোপনীয় স্যার।
ডাক্তারের কাছে গোপন বলতে কিছু নেই। চিকিৎসা নিতে হলে সব বলতে হবে। বলে ফেলো!
কিভাবে যে বলি স্যার! মাথাতে কুকুরের নার্ভ লাগানোর পর থেকে......
পর থেকে কী? বলো, বলে ফেলো!
কুকুরের নার্ভ লাগানোর পর থেকে বিশেষ বিশেষ কাজের সময় কুকুড়ের মতো একটা ঠ্যাং উপড়ের দিকে উঠে যায়। এই যে দ্যাখেন স্যার ছবি তুলে নিয়ে এসেছি। সব ছবিতো দেখানো যায়না... শুধু চুমু খাওয়ার সময়ের ছবিটাই দেখেন!
ডাঃ এ্যালান হতভম্ব দৃষ্টিতে অনন্য আজাদের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে আওড়ালেন, “এ্যা-নুনু আজাদ” এ আমি কি দেখছি?
অনন্য আজাদ বিব্রত কন্ঠে বললো, স্যার নামটা “এ্যা-নুনু ” নয়,“অনন্য”।
© শামীম রেজা
No comments:
Post a Comment