নারী মুক্তি


facebook link
এখন সাড়ে নটা বাজে, আর আধাঘন্টা পরেই শুরু হবে অনুষ্ঠানের মূল কার্যক্রম। অডিটরিয়ামের সিলিং এর এখানে সেখানে ঝুলছে নানান রঙের বেলুন এবং রঙিণ ফিতে।বাহারী ফুলের স্তুপ দিয়ে সাজানো হয়েছে মূল মঞ্চের টেবিল।
বিশাল হলরুম, সারাদেশ হতে আগত নারী প্রতিনিধিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হলরুমের প্রতিটি অংশ। দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলের প্রতিনিধীরা আজ এই নারী উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছে।ছকিনা, জরিনা, ফুলবানু, কদবানু বাদ যায়নাই কেউই।

ফুলবানু অবাক হয়, এতো ফুল! অথচ ঢাকায় আসার পরে একটা ধাণক্ষেত পর্যন্ত কোথাও চোখে পড়েনাই। ফিস ফিস করে জরিনার কানে কানে জিজ্ঞাসা করে, ‘বুবু এতো ফুল আইলো কই থিকা?’
বোকা নাকি! গেট দিয়ে ঢোকার সময় দেহছ নাই, মাডির আড়ি ভর্তি ফুল গাছ? ওইহানেই অইছে, জরিনার কন্ঠে বিরক্তির সুর।

ফুলবানু আবার কিছু বলতে যায়, স্পিকারের শব্দে ঢাকা পড়ে যায় ফুলবানুর কন্ঠ। ঘোশকের কন্ঠে গম গম করে ওঠে বিশাল অডিটরিয়াম।
সম্মানিত উপস্থিতি, ইতোমধ্যেই আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন, নারী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক সুলতানা জামাল।অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমাদের মাঝে বক্তব্য রাখবেন। আপনারদেরকে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

বেশ খোশ মেজাজের মানুষ এই সুলতানা জামাল, দারুন স্মার্ট। কপালে আজ বিশাল টিপ পড়েছেন, লাল টিপ! কড়া মেকাপের আড়ালে হারিয়ে গেছে বয়সের ছাপ, সত্তুর ছুই ছুই বয়সটাকে দেখলে পঞ্চাশের বেশি কেউ বলবেনা।
জরিনার পেটে কুনুই দিয়ে গুতো দেয় ফুলবানু, ফিস ফিস করে দৃস্টি আকর্ষণ করে, ‘জরিবু, ও জরিবু।ওই মাতারী কেডা?’
বিরক্ত হয় জরিনা, ‘তুই হুনছ নাই? এই মাতারীর নাম সুলতানা জামাল’।
‘ওমা, তুই এইডা কি কও জরিবু! নোমো বেডি’র নাম সুলতানা জামাল?’
‘তোরে কেডা কইছে ঐ বেডি নোমো?’
‘তুমি কি কানা? দেহনা ওই মাতারির কপালে লাল টিপ! লাল টিপতো নোমোরাই পরে’।
‘ওইডা তুই বুঝবিনা, ঢাকার মাতারীরা সবাই লালটিপ পরে, হিন্দু-মুসলিম ব্যাপারনা।ব্যাডারা কি কয় হোন, বেশি কথা কইচনা।ইতস্ততভাবে জবাব দেয় জরিনা’।

ডায়াচের দিকে এগিয়ে যান সুলতানা জামাল, অডিটরিয়াম জুড়ে পিনপতন নিরবতা। বেশ কয়েকটি টিভি ক্যামেড়াও হাজির হয়েছে অনুষ্ঠানের নিউজ কাভার করার জন্য।
হাসি মুখে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কথা শুরু করেন সুলতানা জামাল।‘সম্মানিত উপস্থিতি, আজ আমি আপনাদের মাঝে বক্তব্য রাখতে আসিনাই, আমি এসেছি মত বিনিময় করতে। আমি আপনাদের কথা শুনবো, আবার আমার কিছু কথা আছে সেটাও আপনাদের সাথে শেয়ার করবো’।
হাত তালি দিয়ে সুলতানা জামালকে স্বাগত জানালো অডিটরিয়াম ভর্তি নারী প্রতিনিধীরা।

সুলতানা জামাল আবার শুরু করলেন, ‘সম্মানীত উপস্থিতি এই পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারী আজ বন্দী, নারীর মেধা যোগ্যতাকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঘৃণ্য পর্দা প্রথার নামে নারীকে করা হয়েছে গৃহবন্দী। আমাদের নারী উন্নয়ন সমিতি এই বন্দিদশা হতে নারীকে মুক্ত করার লক্ষে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
আমরা নারীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে ঋণ সহায়তা প্রদান করবো, নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো, পুরুষের নির্যাতনের হাত হতে নারীকে সুরক্ষা দিতে আইনি সহায়তা প্রদান করবো’।
তুমুল কড়তালীতে ফেটে পড়ে অডিটরিয়াম। নারী নেত্রীরা স্লোগান ধরেন, “নারী মুক্তি, নারী মুক্তি।বিজয় হবে, বিজয় হবে!”

পেটে কুনুইয়ের খোচা অনুভব করে জরিনা, অগ্নিদৃষ্টিতে ফুলবানুর দিকে তাকায়, ‘কি কবি ক’।
‘আচ্ছা বুবু, আইজ কি ইলেকশন?’
‘হ, তোর মাতা! এতো কথা কস ক্যা?’
‘আরে, রাগো ক্যা? সবাই মিছিল করতাছে এললাইগ্যা জিগাইলাম’।
‘কেউ মাইকে কতা কইলে মাঝে মধ্যে মিছিল করতে অয়, নাইলে যে কতা কয়, হে কতা কইয়া মজা পায়না’।
বুবু আরেকটা কতা জিগাই? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে ফুলবানু।
‘জিগা’।
‘আচ্ছা বুবু ওই মাতারীযে কইলো, নারী আজ বন্দী, নারীরে ঘরে আটকাইয়া রাখছে। এগুলা কার কতা কইতাছে?’
‘এগুলা আমাগো সবার কতা কইতাছে, পুরুষরা আমাগো শাসন করে, আমরা আর পুরুষগো শাসন মানমুনা। আমরাও ব্যাডাগো মতো টাকা কামাই করমু। আমরা ঘরে বন্দি থাকমুনা’।
‘কিযে কওনা বুবু! আমার জামাইতো আমারে খুবই আদর করে। লাজুক লাজুক কন্ঠে জবাব দেয় ফুলবানু। আমার জামাইতো আমারে বন্দী কইরা রাখেনা। তোমার জামাই কি তোমারে বন্দী কইরা রাখে? তাইলে এইহানে আইলা কেমন কইরা?’
‘আরে বুদ্ধু আমি কি একলা আইছি? আমার জামাই আমারে পাহাড়া দিয়া লইয়া আইছে’।
‘তাইলেতো আরো ভালো অইছে, ঢাকায় আসার সময় পতে-ঘাটে অনেক বিপদ অইতে পারতো। জামাই লগে থাকায় সমস্যা ছাড়াই আইতে পারছো।আমার জামাইও আইছে, সে এহন বাইরে খাড়াইয়া আছে। বুঝলা বুবু মানুষটা এতো ভালো, আমারে একটু সময়ের জন্যও চোহের আড়াল করতে চায়না’।
‘অইছে তোর বকবক বন্ধ কর, ম্যাডাম কি কয় মনযোগ দিয়া হোন। এই মাতারী অনেক শিক্ষিত, দামী দামী কতা কয়’।

বক্তব্য দিচ্ছেন সুলতানা জামাল, ‘পর্দা প্রগতির অন্তরায়, নারী মুক্তির পথে প্রধান বাধা পর্দা।যতদিননা আমরা এই ঘৃণ্য পর্দা প্রথার কবল হতে বেরিয়ে আসতে পারছি ততদিন নারী মুক্তি অসম্ভব’।
কড়তালিতে ফেটে পড়ে পুরো অডিটোরিয়াম।
‘শিক্ষায়-চাকরীতে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সাম্প্রদায়ীকতা-মৌলবাদের বিরুদ্ধে নারী সমাজ সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, ফতোয়াবাজদের কবল হতে এই দেশকে মুক্ত করতে মূল ভূমিকা পালন করবে নারী সমাজ।
মোল্লারা আমাদের ভয় দেখাবে, তারা উদ্ভট সব যুক্তি দেখাবে। তারা বলবে পর্দাহীনতার কারণেই সমাজে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা আর মুখ বুজে থাকবোনা, আমরা প্রতিবাদ জানাবো। আমাদের স্লোগান একটাই, “আমরা পর্দা করবোনা, তোমাদের দৃস্টি সামলাও”। এভাবেই নারী এগিয়ে যাবে প্রগতির পথে, উন্নতীর চরম শিখড়ে’।

স্লোগানে স্লোগানে পরিপূর্ণ হলরুম, “নারী মুক্তি, নারী মুক্তি। বিজয় হবে, বিজয় হবে”।
অবাক দৃস্টিতে তাকিয়ে থাকে ফুলবানু, চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাকায় জরিনার দিকে। ভয়ে ভয়েই ডাক দেয়, ‘জরিবু!’
জরিনা সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করেনা, হাত উচিয়ে স্লোগানে মগ্ন।
এবার জোড়ে ডাক দেয় ফুলবানু, সাথে মৃদু ধাক্কা, ‘জরিবু ও জরিবু!’
বিরক্ত হয় জরিনা, ‘এতো ক্যা ক্যা করস ক্যান?’
‘জরিবু, আমারতো ভালো ঠেকতেছেনা!’
‘কি ভালো ঠেকতেছেনা, শরীর খারাপ?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে জরিনা।
‘না জরিবু, শরীর ভালো। কিন্তু ওই মাতারীর কতা-বার্তা ভালো ঠেকতাছেনা’।
‘ক্যা, ওই মাতারী ভুল কি কইছে? হেতো ঠিকই কইছে’।
‘দেহোনা হুজুরগো গালাগালি করতাছে? কি কয় হুজুরগো বোলে প্রতিরোধ করবো! হুজুররাতো ভালো মানুষ, হেগো বিরুদ্ধে কতা কইতাছে ক্যান? যদি কইতো চোর-বদমাইশগো প্রতিরোধ করবো তাইলে একটা কতা আছিলো। হেইডা না কইয়া কয়, হুজুরগো প্রতিরোধ করবো। কি সব উল্ডা-পাল্ডা কতা কয়!’
‘হইছে, তোর এতো বোঝার কাম নাই, হেরা কি কয়ে মনদিয়া হুনতে থাক’।
‘বুবু আরেকটা কতা’, ফুলবানুর কন্ঠে অনুরোধ।
‘আবার কি কতা?’
‘বুবু ওই মাতারী যে কইলো, পর্দা করলে নাকি নারীগো মুক্তি অইবোনা। পর্দার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলো। এইডা কি ঠিক? আমিতো দেখলাম অনেক বেডিরাই পর্দা কইরাও চাকরী করে। এই মাতারী এতো মিছা কত কয় ক্যা?’
‘ওইগুলা তুই বুঝবিনা, শিক্ষিত মাইনষের কতা বুঝার মতো জ্ঞান তোর অয়নাই’।ধমক দিয়ে ফুলবানুকে থামিয়ে দেয় জরিনা।

চিন্তিত ফুলবানু, বুকভরা প্রশ্নের জাল, এই জাল ছিন্ন করবে সাধ্যকার। বক্তব্য দিচ্ছেন সুলতানা জামাল, কড়তালি এবং স্লোগানে সমর্থন দিচ্ছে উপস্থিত শ্রোতারা।
একসময় দুপুর হয়ে যায়, সবার হাতে হাতে পৌছে যায় বিড়ানীর প্যাকেট। খাওয়া শেষ, প্রগ্রাম শেষ। দলে দলে বেরিয়ে যাচ্ছে নারী উন্নয়ন কর্মীরা। সবার মুখে একটাই স্লোগান, “আমি পর্দা করবোনা, তোমার দৃস্টি সামলাও”

বাড়ি যাওয়ার জন্য বোরখাটাকে ঠিক-ঠাক করে নিচ্ছে ফুলবানু।শাড়ির আচলটাকে কোমড়া বেধে জরিনাও প্রস্তুতি নিচ্ছে। কানের,গলার এবং হাতের স্বর্নের গয়নাগুলো খুলে একটা কাপড়ের পুটলিতে বেধে সেটাকে কোমড়ের গোপন স্থানে চালান করে দিলো জরিনা।
অবাক দৃস্টিতে জরিনার দিকে তাকিয়ে থাকে ফুলবানু। বিস্মিত কন্ঠেই প্রশ্ন করে, ‘বুবু এইটা কি করলা, গয়নাগুলা খুইলা রাখলা ক্যান?’
‘বাড়ি যাইতে যাইতে অনেক রাইত হইবো, পথে-ঘাটে ছিনতাইকারী ধরতে পারে, তাই সাবধান থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ’। জরিনার ঠোটে বিজ্ঞের হাসি।
‘তোমারতো দেখি অনেক বুদ্ধি! বুবু তারাতারি বোরখা পইরা রেডি হও, নাইলে বাস পাবানা’।
তুই এতোক্ষণ কি শিখলি? জরিনার কন্ঠে বিরক্তি। ‘আমি আইজ থিকা পর্দা করমুনা। পুরুষগো কমু চোখ সামলাইতে’।
বোরখার নেকাব লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন করে ফুলবানু, ‘বুবু স্বর্ণের জিনিসগুলা লুকাইয়া রাখলা, আর শরীরটা খুইলা রাখলা! ঐ স্বর্ণগুলাকি তোমার শরীরের চাইতে বেশি দামী?’
‘কি কইলি তুই?!’ রাগত কন্ঠে প্রশ্ন করে জরিনা।
‘না, কিছু কইনাই।নতুন একটা স্লোগান মাথায় আইলো, হেইডাই কইতাছিলাম। ফুলবানু জরিনার কন্ঠ কপি করে,“আমি স্বর্ণের গয়না লুকাবোনা, ছিনতাইকারী তোমার লোভ সামলাও’

দরজার দিকে এগিয়ে যায় ফুলবানু, নিশ্চল পাথরের মূর্তি জরিনা, কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। কন্ঠ চিড়ে বেরিয়ে আসে, “ফুলবানু ইট্টু খাড়া, আমি বোরখা পইড়া আইতাছি”।

আঞ্চলিক ভাষা সমাধাণঃ ১।মাতারী=মহিলা, ২।নোমো=হিন্দু

গল্পঃ নারী মুক্তি
শামীম রেজা
০২/০২/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment