রক্তের সম্পর্ক

চট্টগ্রাম মেডিক্যালে তখন রক্ত দেয়ার রুম ছিলো সম্ভবত তৃতীয় তলায়, রক্ত দেয়ার রুমে ঢুকতেই চোখে পড়লো ভয়ঙ্কর দর্শন বিশাল এক ফোল্ডিং চেয়ার, চেয়ারের সাথে সংযুক্ত নানান রকমের কেবল এবং রাবারের পাইপ। দেখতেই কেমন যেনো গা ছম ছম করছিলো।
লম্বা চেয়ারে সটান শুয়ে পড়লাম, আমার পাশের বেডেই রক্ত দিচ্ছিলো নাদুস নুদুস গড়নের আরেকটা ছেলে, নির্বিকার ভঙ্গিতে হাতে রাখা রাবারের বল জাতীয় কিছু একটা চাপছিলো।
বুকে কিছুটা সাহস ফিরে পেলাম। এই ছেলে পারলে আমি কেনো পারবোনা! অবশ্যই পারবো। যদিও গায়ে মাংসের চাইতে হাড়ের পরিমান বেশি, তবুও সাহস সঞ্চয় করে নিলাম।

কাহিনী হচ্ছে, ক্যান্সার আক্রান্ত এক তরুণের রক্তের প্রয়োজন, মহানগরীর দায়িত্বশীল হোসাইন ভাই এক প্রকার জোর করেই আমাকে তুলে এনেছেন রক্ত দেয়ার জন্য। মনে প্রচন্ড ভয় কাজ করলেও, আমার রক্তে একজন মানুষের জীবন রক্ষা পাবে ভেবে খুব একটা অমত করিনাই।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতের মধ্যে সুঁই ঢুকে গেলো, দেখতে দেখতেই এক ব্যাগ রক্ত শরীর হতে বেরিয়ে গেলো এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যেই নাদুস নুদুস ছেলেটিকে দেখে আমি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করেছিলাম, তার রক্তের ব্যাগ তখনো ফিলাপ হয় নাই। বুঝে গেলাম, দেহে গোস্ত না থাকলে কি হবে, ভেতরে রক্তের পরিমাণ যথেস্ট!
আমি যেখানে রক্ত দিয়ে সাবলীল ভাবে হেটে বেড়াচ্ছিলাম, ঠিক তখনি সেই স্বাস্থবান ভাইটিকে নিয়ে টানা-হেচড়া শুরু হয়ে গেলো। রক্ত দিয়ে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।
রক্ত দেয়ার পরে যেহেতু আমার মধ্যে কোনো দূর্বলতা অনুভব করিনাই, সেহেতু বুঝে নিলাম, “বনের বাঘে খায়না, মনের বাঘেই খায়”।

প্রথমবার রক্ত দেয়ার পরে মনের ভয় অনেকটাই দূর হয়ে গেলো, এরপরেও দুই-তিনবার রক্ত দিতে গিয়েও ফিরে এসেছি শেষ মূহুর্তে রক্তের প্রয়োজন না হওয়ার কারনে।
সেদিন সাইফুল ভাই ধরলেন তার বন্ধুর ভাগ্নীর জন্য রক্তের প্রয়োজন, রক্ত দিতে হবে। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো রক্তের প্রয়োজন হলে সংগঠনের কাউকে দিবো, বাহিরের কাউকে দিবোনা, কারণ প্রয়োজনের সময় সহজে রক্ত পাওয়া যায়না । কিন্তু সাইফুল ভাইয়ের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম।
রক্ত দেয়া শেষ হলে রোগী আমাকে দেখতে চাইলেন। সালাম বিনিময় হলো, কথা হলো, জানতে পারলাম আমার নিয়্যত ব্যর্থ হয়নাই। যাকে রক্ত দিয়েছি তিনি আমার সংগঠনেরই একজন। তিনি ছাত্রীসংস্থার অগ্রসর কর্মী।

গতকাল রক্ত চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম, রোগী আমার বন্ধুর পরিচিত। পোস্ট থেকে ফোন নম্বর নিয়ে, নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুকে কেউ একজন গিয়ে রক্ত দিয়ে এসেছেন। অনেক অনেক ভালো লাগলো, সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা, অনাত্মীয় একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এভাবে নিস্বার্থভাবে রক্ত দেয়ার মানসিকতা নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যাবে।
রক্ত দাতার প্রতি রইলো অনেক অনেক দোয়া, আল্লাহ তার এই উদারতাকে কবুল করুন।


লেখাঃ রক্তের সম্পর্ক

শামীম রেজা
৩০/০৫/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment