হরতালঃ কল্যান এবং অকল্যান

প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলাম কেবলমাত্র তাত্ত্বিক আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়, ইসলাম হচ্ছে মানব জীবনের জন্য প্রয়োগিক বিধান।
পবিত্র কুরআন শরীফে মহান রব্বুল আলামীন স্পষ্ট করে বলেছেন চুরির অপরাধে হাত কেটে ফেলতে হবে, কিন্তু দূর্ভিক্ষ চলাকালীন সময়ে হজরত ওমর (রাঃ) চুরির শাস্তি হাত কাটার বিধান স্থগিত করেন। কারণ ক্ষুধার তাড়নায় কেউ কেউ খাবার চুরি করতে পারে। এভাবেই ইসলাম মানব জীবনের বিভিন্ন সমস্যার চমৎকার সমাধান দিয়েছে।

আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সাঃ) বলেন, ‘তোমরা রাস্তার উপর বসা থেকে বিরত থাক”।সাহাবাগন বলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! রাস্তায় বসা ছাড়া তো আমাদের কোন উপায় নেই।আমরা সেখানে বসে পারস্পরিক প্রয়োজন সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা করে থাকি”।
রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বলেনঃ “তোমরা যখন রাস্তায় বসা থেকে বিরত থাকতে অস্বীকার করছ, তাহলে রাস্তার অধিকার আদায় কর”। তারা বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! রাস্তার অধিকার আবার কি?” তিনি বলেনঃ “রাস্তার অধিকার হল, ১ দৃষ্টি সংযত রাখা, ২ রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা, ৩ সালামের জবাব দেয়া, ৪ সৎ কাজের নির্দেশ দেয়া এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা”। [বুখারী ও মুসলিম]

মক্কার কাফেররা মুসলমানদেরকে তাদের বসতভিটা হতে উৎখাত করলো, তাদের সম্পদ লুটপাট করলো, এবং কঠোর নির্যাতন চালালো সাহাবীদের উপর।
মদীনার পাশ দিয়েই ছিলো মক্কার বাণিজ্যপথ, হিজরী ২য় সালে রাসূল (সা.) জানতে পারলেন আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কাফেরদের একটি বাণিজ্যদল মক্কার দিকে যাচ্ছে। রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, কাফের শক্তির অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল করার জন্য এবং দেশত্যাগী মুহাজের মুসলমানদের সম্পদ উদ্ধার করার জন্য কাফেরদের এই বাণিজ্য দলকে ধাওয়া করবেন। এবং এরই ফলশ্রুতিতে বদরযুদ্ধ সংঘঠিত হয়।

উপরের হাদিস হতে দেখা যায়, রাসূল(সঃ) একদিকে পথের উপর বসে মানুষকে কষ্ট দিতে সাহাবীদের নিষেধ করেছেন, আবার অন্যদিকে কাফেরদের অর্থনৈতিক ভিত্তি দূর্বল করার জন্য মদীনার পার্শবর্তী সড়কে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলায় হামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
এই দুইটি ঘটনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, যুদ্ধকালীন এবং শান্তিকালীন অবস্থা এক নয়, যেমন শীতকালীন পোশাক এবং গ্রীস্মকালীন পোশাক এক নয়। ইসলামের শত্রুকে অর্থনৈতিক/সামরিক/রাজনৈতিকভাবে দূর্বল করার জন্য রাস্তা অবরোধ যায়েজ।

এখানে আরো উল্লেখ্য যে, তৎকালীন আরবের বাণিজ্য কাফেলাতে শুধুমাত্র একক ব্যাক্তির সম্পদ থাকতোনা, একটি কাফেলাতে একটি গোত্রের সম্মিলিত বাণিজ্য উপকরণ পরিবহন করা হতো। আর এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় অনেক নিরীহ মানুষের সম্পদও আবু সুফিয়ানের সেই কাফেলাতে ছিলো, যারা সাহাবীদের উপর নির্যাতনে শরীক ছিলেননা। তবে যেহেতু তারা নির্যাতনকারীদের সর্দার আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বাণিজ্য পরিচালনা করেছিলেন সেহেতু তাদের সম্পদও আক্রমনের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছিলো।

হুদাইবিয়া সন্ধির একটি শর্ত ছিলো, মদীনা হতে কেউ যদি ইসলাম ত্যাগ করে মক্কায় আশ্রয় চায় তবে মক্কা তাকে আশ্রয় দিবে। কিন্তু মক্কা হতে কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় আশ্রয় চায় তবে মদীনা তাকে আশ্রয় দিতে পারবেনা। রাসূল(সঃ) এই শর্ত মেনেই চুক্তিতে সাক্ষর করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে মক্কা হতে ইসলাম গ্রহণ করে কেউ মদীনা পালিয়ে এলে চুক্তির শর্ত মোতাবেক রাসূল(সঃ) তাদের আশ্রয় দিতেননা, সবরের নির্দেশ দিয়ে ফিরিয়ে দিতেন।
সেইসব নওমুসলিম সাহাবী যাদের রাসূল(সঃ) ফিরিয়ে দিতেন তারা গিয়ে ঘাটি গাড়তো মক্কার বাণিজ্য কাফেলার চলাচলকারী রাস্তার পাশে একটি পাহাড়ের গুহায়। সেখান হতে মাঝে মধ্যেই তারা মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় হামলা করে কুরাইশদের পেরেশান করে দিতো।
অবশেষে ত্যাক্ত-বিরক্ত কুরাইশরা রাসূল(সঃ) এর কাছে এসে চুক্তির ওই ধারাটি বাতিল এবং পাহাড়ের গুহায় অবস্থানগ্রহণকারী সেই সাহাবীদের ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। এই ঘটনার মাধ্যমেও প্রমাণীত সাহাবীরা সড়ক অবরোধ করে ইসলামের দুশমনদের হয়রানী করেছিলেন।

বর্তমান জালিম আওয়ামী সরকার বাংলাদেশ হতে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলার পরিকল্পনা স্বরুপ, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর উপর ইতিহাসের নির্মমতম জুলুম নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। ঘড়-বাড়ি ছাড়া করেছে জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরের কর্মীদেরকে, লুটপাট-ভাঙচুর করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের অসংখ্য কর্মী সমর্থককে, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে বন্দী করা হয়েছে কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে, সাজানো আদালতে দেয়া হয়েছে ফাঁসির নির্র্দেশ।

জামায়াতে ইসলামী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো সরকারের অর্থনৈতিক/রাজনৈতিক ভিত্তি দূর্বল করে দেয়া হবে।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক হরতাল আহ্বান করা হলো, হরতালের ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যায়, এবং সরকার হারায় বিপুল পরিমান রাজস্ব, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা নির্দিধায় ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে হরতাল আহ্বানকারীদের দাবী মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে।
যেহেতু জামায়াত একটি ইসলামী দল, সেহেতু ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতা স্বতস্ফূর্তভাবে এই হরতাল সমর্থন করে সব ধরণের ব্যবসা এবং পরিবহন বন্ধ রাখে। আর মক্কার কুরাইশদের মতো যারা আওয়ামিলীগের অনুসারী তারা হরতাল প্রত্যাক্ষাণ করে, ব্যবসা এবং পরিবহণ পরিচালনা করে।
যেহেতু একটি ইসলামী সংগঠন হরতাল আহ্বান করেছে, সেহেতু সরকারকে খুশি রাখতে যেসব পরিবহন রাস্তায় চলাচল করে সেগুলোতে হামলা করা ওই ইসলামী সংগঠনের নৈতিক দায়ীত্ব।

অনেক ভাই প্রশ্ন করেন, যারা হরতাল আহ্বান করেছে এবং যারা হরতাল অস্বীকার করছে তারা উভয়েই মুসলিম, কিন্তু রাসূল(সঃ) কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে নয়। তাদের অবগতির জন্য বলছি, হজরত আলী (রা) এবং মুয়াবিয়া (রাঃ) এর মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিলো সেটা কিন্তু কাফের এবং মুসলিমের সংঘাত নয়, সেটা ছিলো দুইদল মুসলিম নিজেদের অবস্থানে সঠিক দাবী করে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নিশ্চিতভাবে সেখানে একপক্ষের অবস্থান সঠিক ছিলো এবং অন্যপক্ষ ভুল ছিলো। এই ঘটনার মাধ্যমেও প্রমানিত যে একদল মুসলিম নিজের অবস্থানে সঠিক হলে অন্যদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়েজ।
তাছাড়া স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাসূল(সঃ) নির্দেশ প্রদান করেছেন। রাসূল(সঃ) এর এই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, ঈমাম হাসান এবং হোসেন (রাঃ)।

আরেকটি ব্যাপারে দৃস্টি আকর্ষণ করছি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিরীহ মানুষের জানমালের দোহাই দিয়ে, জালিম সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বানের প্রতিবাদ জানিয়ে যেসব ভাই বক্তব্য রাখছেন, ঠিক তারাই আবার সিরিয়ার স্বৈরশাসক জালিম বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন করছেন।
তাদের উদ্দেশ্য একটি প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি, সিরিয়ার মুজাহিদদের রকেট হামলার কারণে নিরীহ মুসলিম নিহত হয়না? সিরিয়ার জালিম আসাদ বিরোধী এই যুদ্ধে নিরীহ মুসলিমের ব্যবসা এবং বাড়িঘড় ধ্বংশ হয়না? এতিম এবং বিধবা হয়নাই কোনো বনী আদম? দিনে আনে দিন খায় এমন লোকের কর্মের একমাত্র উৎস নষ্ট হয়নাই? তবে কেনো আপনারা এই যুদ্ধকে সমর্থন দিচ্ছেন, তারচাইতে বাশার আল আসাদ ভালো ছিলোনা? তার শাসন আমলে অন্তত ইট ভেঙ্গে একটা লোক তার রিজিক আহরণ করতে পারতো, এই যুদ্ধের ফলেতো সেটাও নষ্ট হলো।

বৃহত্তর কল্যানের স্বার্থে ক্ষুদ্রস্বার্থ পরিত্যাগ করেছে সিরীয় মুজাহিদরা। জালিম বাশার আসাদের পতন হলে এর চাইতেও উন্নত এবং সমৃদ্ধ স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবে সিরিয়ার ভবিষ্যত প্রজন্ম।
বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতাও বৃহত্তর কল্যানের লক্ষে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ পরিত্যাগ করেছে। আলহামদুলিল্লাহ সিরিয়ার তৌহিদী জনতার মতো এখনো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার প্রয়োজন হয়নাই, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচীর মাধ্যমে এই জালিম সরকারের পতন ঘটিয়ে জাতীকে উপহার দেয়া হবে একটি সমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ, ইনশাআল্লাহ্‌।

১৪ নভেম্বর ২০১৩

Post Comment

No comments:

Post a Comment