facebook link
জমির উদ্দীন কই গেলা, বাড়িতে আছো? আলিম মিয়া
উঠান হতেই হাক ছাড়েন। এই গ্রামের সজ্জন মানুষ হিসেবেই আলিম মিয়া পরিচিত, কখনো
মানুষের ভালো ছাড়া খারাপ করেছেন বলে কারো জানা নেই।
হন্ত-দন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে জমির উদ্দিন।
আরে, আলিম ভাইযে! কেমন আছেন? অনেক দিন পরে এলেন, আসেন আসেন ঘরে আসেন।
না না, ঘরে যাবোনা প্রচন্ড গরম পড়ছে, বাহিরেই বসি। তুমি এক কাজ করো, দুইটা পিড়ি নিয়ে আসো বসে কিছু কথা বলি।
জমির উদ্দীন পিড়ি আনতে ঘরে চলে যায়। আলিম মিয়া খুটিয়ে খুটিয়ে জমির উদ্দীনের ঘর দেখে, দিনমজুর জমির উদ্দীনের অভাবের সংসার, ভাঙা-চোড়া বসতঘরে বিদ্যুতের লাইন নেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ নাই। প্রচন্ড এই গরমে হাত পাখাই একমাত্র উপায়।
দরজা দিয়ে ভেতরে তাকালে এক দৃস্টিতেই পুরো ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। ঘরের মাঝা মাঝি পার্টিসন করে দুইটা রুম বানানো হয়েছে, সামনের রুমে থাকে জমির ও তার স্ত্রী এবং ভেতরের দিকের রুমে জমিরের তিন মেয়ে।
নেন ভাই বসেন, জমির উদ্দীন কাঠের পিড়ি এগিয়ে দেয়। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে আলিম মিয়াকে জিজ্ঞাসা করে, তা ভাই হঠাৎ কি মনে করে?
আলিম মিয়া কাগজের প্যাচ থেকে পান বের করে মুখে পুড়ে দেয়। পান চিবোতে চিবোতেই একবার জমিরের মুখের দিকে তাকায়। কথাটা যে কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা।
আপনারে চিন্তিত মনে হচ্ছে ভাই, কি কোনো সমস্যা?
আলিম মিয়া মনে মনে কথা গুছিয়ে নেয়, জমির উদ্দীন তোমার সাথে কিছু জরূরী কথা ছিলো, মনযোগ দিয়ে শোনো। তোমার বড় মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?
ক্লাস টেনে পড়ে, এবার মেট্টিক দিবো!
মেয়ের ব্যাপারে কোনো খোজ খবর রাখো? কোথায় যায়, কি করে?
ক্যান ভাই কি হইছে? জমিরের কন্ঠে উৎকণ্ঠা।
আমি কিছু কথা বলছি, তুমি মাথা ঠান্ডা রাখবা, মাথা গরম করলে তোমারই ক্ষতি হবে, বড়-সড় ক্ষতি!
গত সপ্তাহে দেখলাম উত্তর কান্দির হাশেমের নেশাখোর ছেলে মন্টুর সাথে তোমার মেয়ে, মার্কেটের এক ফার্স্টফুডের দোকানে খুবই অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলছে। আজ শহরে গিয়েছিলাম কিছু কাজ ছিলো, আসার পথে দেখলাম ওই ছেলের সাথেই রিক্সায় করে কোথায় যেনো যাচ্ছে!
জমির মাথা নিচু করে আছে, দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। লজ্জ্বায় অপমানে দুঃখে, আলিম মিয়ার দিকে তাকাতে পারছেনা। হঠাৎ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে উঠে দাড়ায় জমির, বউয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে যায় ঘরের ভেতর, শুরু হয় তীব্র চেচামেচি। আলিম মিয়া এখান হতেই শুনতে পাচ্ছেন নারী কন্ঠের চিৎকার, মেয়ে কোচিং-এর নাম করে বাইরে গেছে, আমার কি করার আছে, আমি কি মাইয়ার পিছে পিছে যামু নাকি! এর পর ধুপ-ধাপ কিল-ঘুশি এবং নারী কন্ঠের তীব্র চেচামেচী/কান্নাকাটি’র শব্দ ভেসে আসে।
হৈ চৈ শুনে প্রতিবেশীরা এসে হাজির! তীব্র হাঙ্গামা। দীর্ঘস্বাস ফেলে নীরবে প্রস্থান করেন আলিম মিয়া।
আলিম মিয়ার বিশাল বাড়ি, বৈঠক খানায় কাচু-মাচু মুখে বসে আছে জমির!
তোমাকে বলছিলাম মাথা ঠান্ডা রাখবা, কিন্তু তুমি এইটা কি করলা? আলিম মিয়া জিজ্ঞাসু দৃস্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আলিম ভাই, মাথা গরম হয়ে গেছিলো। আমি কি করবো বুঝতে পারিনাই।
তুমি বুঝতে পারোনাই ভালো কথা, কিন্তু বউটাকেতো ঠিকই পিটাইলা। বউয়ের কি দোষ? সারাদিন বাইরে থাকো তুমি, মেয়ে কোথায় যায় কি করে খোজ রাখার দায়ীত্ব তোমার। তোমার বউ কি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে?
আলিম মিয়ার হাত চেপে ধরে জমির। আলিম ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে, আপনি একটা কিছু করেন, এই বিপদ হতে উদ্ধার করেন।
আপনিতো শুধু মন্টুর কথা বলছেন, কিন্তু বাড়িতেওতো শান্তিতে থাকতে পারিনা, বাড়ির সামনে গ্রামের বখাটে পোলাপান খালি ছোক ছোক করে, ঘরে জোয়ান মাইয়া নিয়ে চিন্তায় ঘুম হয়না। আমি দিনমজুর মানুষ! মেয়েটার ক্ষতি হয়ে গেলে গ্রামে মুখে দেখাতে পারবোনা।
'এক কাজ করো, মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দাও'।
'আমি গরীব মানুষ, এই মূহুর্তে বিয়ে দেয়ার মতো টাকা-পয়সা হাতে নাই'।
'তুমি টাকার চিন্তা কইরোনা, সেই দিকটা আমি দেখবো। হাশেমের পারিবারিক-আর্থিক অবস্থা ভালো, যদি হাশেম রাজী হয় তবে তার ছেলের সাথেই বিয়ে দাও, ছেলে-মেয়ের পছন্দতে আমাদের অমত করার কি আছে?'
'কিন্তু হাশেমের পোলায়তো নেশা করে, আর স্বভাব চরিত্রও ততটা ভালো না!'
'শোনো, মানুষ চিরজীবন এক রকম থাকেনা, বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে'।
দুনিয়াটা বড় বৈচিত্রপূর্ণ, মানুষগুলো আরো বৈচিত্রময়, মন্টু আকাশ হতে পড়ে, কিসের সম্পর্ক? আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নাই। হাশেম তাচ্ছিল্যের সাথে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাক্ষাণ করে, একটা দিনমজুরের মেয়েকে ছেলের বউ বানানো অসম্ভব!
জমিরের মেয়েটা ইঁদুরের ঔষধ খেলো, আল্লাহর দয়ায় হাসপাতাল হতে বেচে ফিরেছে, তবে সারাক্ষণ ঝিমায়, উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে, তিনবার জিজ্ঞাসা করলে একটা কথার উত্তর পাওয়া যায়। চোখের সামনে মেয়েটা কেমন যেনো হয়ে গেছে, আচলে চোখ মোছে জমিরের বউ।
জমিরের সামনে ধু! ধু! অন্ধকার, ফ্যাকাসে ভবিষ্যৎ! বাড়ির সামনে বখাটে ছেলেদের আনাগোনা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে, রাতের বেলা টিনের চালে কারা যেনো ঢিল ছুড়ে মারে।
রাতে ভালো ঘুম হয়নাই, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, দাওয়ায় বসে আছে জমির, আজকে কাজে যেতে ইচ্ছে করছেনা।
জমির বাড়িতে আছো? বাহির হতেই হাক ছাড়ে আলিম মিয়া।
উঠে দাড়ায় জমির, ভাই কেমন আছেন? অনেক দিন এদিকটাতে আসেননা।
ব্যস্ত থাকিতো, তাই সময় পাচ্ছিনা, তা কেমন আছো? বউ বাচ্চা সবাই ভালো আছেতো?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তবে মেয়েটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়, রাতে কারা যেনো চালে ঢিল ছোড়ে, বাড়ির সামনে পোলাপান ঘুড়-ঘুড় করে।
শোনো, মেয়ের জন্য ভালো একটা প্রস্তাব এনেছি, ছেলে গার্মেন্টসে চাকরি করে, ভালো টাকা বেতন পায়, আচার ব্যবহার চমৎকার, বিয়ের পরে বউকে শহরে নিয়ে যাবে। চিন্তা করে দেখো, বিয়ে দিবে কিনা!
কি বলছেন আলিম ভাই, আপনি যেই ছেলে সম্পর্কে ভালো বলছেন, সেখানে আমাদের আপত্তি থাকবে কেনো? তবে সমস্যা হলো, ছেলেকি আমাদের অবস্থা জানে?
ও নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা, আমি সব খুলে বলেছি, আমার কথাতেই ছেলের পরিবার এই প্রস্তাবে মত দিয়েছে। আর বিয়ের খরচের ব্যাপারে তুমি চিন্তা করবানা। সব দায়িত্ব আমার।
ব্যাপক মেহমান এসেছে বিয়েতে, আলিম মিয়া ঘোশণা দিয়েছেন, নিজের মেয়ের বিয়েতে যতবড় অনুষ্ঠান করেছি, জমিরের মেয়ের বিয়েতেও ঠিক ততবড় অনুষ্ঠান হবে। দলে দলে গ্রামের মানুষ হাজির হচ্ছে।
জমিরের মেয়েটার সেই বিষন্ন ভাবটা আর নেই, যে চোখে ছিলো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন, সেই চোখেই আজ ভাসছে সুখস্বপ্ন! যে হৃদয় ছিলো চৈত্রের খাখা দুপুর, সেখানেই বইছে শ্রাবনের বাড়ি ধারা! সেই পুতুল খেলার বয়স হতেই প্রতিটি মেয়ের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকে ঘর বাধার স্বপ্ন, নিজের একটা সংসার, সুখী সংসার!
অসম্ভব রকম ব্যস্ত জমির উদ্দিন, চারিদিক হতে মেহমান আসছে, খাবার-দাবার নিয়ে সে এক এলাহী কান্ড। ছোট ছোট বাচ্চারা শোরগোল করে উঠলো, বড় এসেছে! বড় এসেছে!
কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা জমির উদ্দীন ব্যাকুল হয়ে ছুটে গেলো বড়ের গাড়ির দিকে। মেহমানদের যেনো কোন রকমের অসুবিধা না হয়, তারা যেনো বদনাম করতে না পারে। বড় পক্ষ অসন্তুষ্ট হলে শশুর বাড়ি হতে মেয়েকে খোঁটা শুনতে হয়, এটাই নিয়ম!
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পর্ব শুরু হচ্ছে, কাজী সাহেব খাতা খুলে লেখালেখির কাজ সম্পন্ন করে নিয়েছেন। অনুষ্ঠান স্থলে হাজির হলেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, নারী অধিকার সংগঠনের নেত্রী, ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট সহ নানা রকম এনজিও ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি।
জমির মিয়া ছুটে গেলেন, আরে চেয়ারম্যান সাহেব যে, আমার কি সৌভাগ্য, এই তোরা চেয়ার দে! লোকজন ছোটাছুটি করে চেয়ার এগিয়ে দিলো। গর্বে জমির উদ্দিনের বুক ফুলে উঠলো, এতো গুলো হোমড়া চোমড়া অফিসার সহ চেয়ারম্যান সাহেব তার মেয়ের বিয়েতে এসেছেন! নিশ্চই আলীম ভাইয়ের কাজ, আলীম ভাই দাওয়াত না দিলেতো তারা আসার কথা না।
আলিম মিয়া হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এলেন, উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, চেয়ারম্যান সাহেব আপনি? আর অফিসার সাহেবরাই বা কেনো?
নারী অধিকার সংগঠনের সভানেত্রি সামনে এগিয়ে এলেন, আপনারা এগুলো কি শুরু করেছেন? একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন? আপনাদেরতো পুলিশে দেয়া উচিত! ইউএনও সাহেবও এগিয়ে এলেন, সার্টিফিকেট অনুযায়ী মেয়ের বয়স ১৮হয়নি, ১৬বছর বয়সের মেয়েকে বিয়ে দেয়া যাবেনা, সে এখনো শিশু!
বড় যাত্রিরা একে একে বিদায় নিয়েছে, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে চাইছিলো। কত্তবড় সাহস, বাল্যবিবাহ দেয়! চেয়ারম্যানের অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেয়া হলো।
হতভম্ব আলিম মিয়া, হতভম্ব জমির উদ্দিন! নির্বাক দৃস্টিতে তাকিয়ে আছেন জমিরের বউ, বুক ভাঙা আর্তনাদ আর হাহাকারে বোধহয় আল্লাহর আরশও কেপে উঠছে।
জমিরের মেয়েটি একবার বোধহয় হেসে উঠেছিলো, তারপরেই জ্ঞান হারায়। লোকে বলাবলি করছে, জমিরের মেয়ে পাগল হয়ে গেছে!
১৬সেপ্টেম্বর২০১৩
হন্ত-দন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে জমির উদ্দিন।
আরে, আলিম ভাইযে! কেমন আছেন? অনেক দিন পরে এলেন, আসেন আসেন ঘরে আসেন।
না না, ঘরে যাবোনা প্রচন্ড গরম পড়ছে, বাহিরেই বসি। তুমি এক কাজ করো, দুইটা পিড়ি নিয়ে আসো বসে কিছু কথা বলি।
জমির উদ্দীন পিড়ি আনতে ঘরে চলে যায়। আলিম মিয়া খুটিয়ে খুটিয়ে জমির উদ্দীনের ঘর দেখে, দিনমজুর জমির উদ্দীনের অভাবের সংসার, ভাঙা-চোড়া বসতঘরে বিদ্যুতের লাইন নেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ নাই। প্রচন্ড এই গরমে হাত পাখাই একমাত্র উপায়।
দরজা দিয়ে ভেতরে তাকালে এক দৃস্টিতেই পুরো ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। ঘরের মাঝা মাঝি পার্টিসন করে দুইটা রুম বানানো হয়েছে, সামনের রুমে থাকে জমির ও তার স্ত্রী এবং ভেতরের দিকের রুমে জমিরের তিন মেয়ে।
নেন ভাই বসেন, জমির উদ্দীন কাঠের পিড়ি এগিয়ে দেয়। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে আলিম মিয়াকে জিজ্ঞাসা করে, তা ভাই হঠাৎ কি মনে করে?
আলিম মিয়া কাগজের প্যাচ থেকে পান বের করে মুখে পুড়ে দেয়। পান চিবোতে চিবোতেই একবার জমিরের মুখের দিকে তাকায়। কথাটা যে কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা।
আপনারে চিন্তিত মনে হচ্ছে ভাই, কি কোনো সমস্যা?
আলিম মিয়া মনে মনে কথা গুছিয়ে নেয়, জমির উদ্দীন তোমার সাথে কিছু জরূরী কথা ছিলো, মনযোগ দিয়ে শোনো। তোমার বড় মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?
ক্লাস টেনে পড়ে, এবার মেট্টিক দিবো!
মেয়ের ব্যাপারে কোনো খোজ খবর রাখো? কোথায় যায়, কি করে?
ক্যান ভাই কি হইছে? জমিরের কন্ঠে উৎকণ্ঠা।
আমি কিছু কথা বলছি, তুমি মাথা ঠান্ডা রাখবা, মাথা গরম করলে তোমারই ক্ষতি হবে, বড়-সড় ক্ষতি!
গত সপ্তাহে দেখলাম উত্তর কান্দির হাশেমের নেশাখোর ছেলে মন্টুর সাথে তোমার মেয়ে, মার্কেটের এক ফার্স্টফুডের দোকানে খুবই অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলছে। আজ শহরে গিয়েছিলাম কিছু কাজ ছিলো, আসার পথে দেখলাম ওই ছেলের সাথেই রিক্সায় করে কোথায় যেনো যাচ্ছে!
জমির মাথা নিচু করে আছে, দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। লজ্জ্বায় অপমানে দুঃখে, আলিম মিয়ার দিকে তাকাতে পারছেনা। হঠাৎ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে উঠে দাড়ায় জমির, বউয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে যায় ঘরের ভেতর, শুরু হয় তীব্র চেচামেচি। আলিম মিয়া এখান হতেই শুনতে পাচ্ছেন নারী কন্ঠের চিৎকার, মেয়ে কোচিং-এর নাম করে বাইরে গেছে, আমার কি করার আছে, আমি কি মাইয়ার পিছে পিছে যামু নাকি! এর পর ধুপ-ধাপ কিল-ঘুশি এবং নারী কন্ঠের তীব্র চেচামেচী/কান্নাকাটি’র শব্দ ভেসে আসে।
হৈ চৈ শুনে প্রতিবেশীরা এসে হাজির! তীব্র হাঙ্গামা। দীর্ঘস্বাস ফেলে নীরবে প্রস্থান করেন আলিম মিয়া।
আলিম মিয়ার বিশাল বাড়ি, বৈঠক খানায় কাচু-মাচু মুখে বসে আছে জমির!
তোমাকে বলছিলাম মাথা ঠান্ডা রাখবা, কিন্তু তুমি এইটা কি করলা? আলিম মিয়া জিজ্ঞাসু দৃস্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আলিম ভাই, মাথা গরম হয়ে গেছিলো। আমি কি করবো বুঝতে পারিনাই।
তুমি বুঝতে পারোনাই ভালো কথা, কিন্তু বউটাকেতো ঠিকই পিটাইলা। বউয়ের কি দোষ? সারাদিন বাইরে থাকো তুমি, মেয়ে কোথায় যায় কি করে খোজ রাখার দায়ীত্ব তোমার। তোমার বউ কি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে?
আলিম মিয়ার হাত চেপে ধরে জমির। আলিম ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে, আপনি একটা কিছু করেন, এই বিপদ হতে উদ্ধার করেন।
আপনিতো শুধু মন্টুর কথা বলছেন, কিন্তু বাড়িতেওতো শান্তিতে থাকতে পারিনা, বাড়ির সামনে গ্রামের বখাটে পোলাপান খালি ছোক ছোক করে, ঘরে জোয়ান মাইয়া নিয়ে চিন্তায় ঘুম হয়না। আমি দিনমজুর মানুষ! মেয়েটার ক্ষতি হয়ে গেলে গ্রামে মুখে দেখাতে পারবোনা।
'এক কাজ করো, মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দাও'।
'আমি গরীব মানুষ, এই মূহুর্তে বিয়ে দেয়ার মতো টাকা-পয়সা হাতে নাই'।
'তুমি টাকার চিন্তা কইরোনা, সেই দিকটা আমি দেখবো। হাশেমের পারিবারিক-আর্থিক অবস্থা ভালো, যদি হাশেম রাজী হয় তবে তার ছেলের সাথেই বিয়ে দাও, ছেলে-মেয়ের পছন্দতে আমাদের অমত করার কি আছে?'
'কিন্তু হাশেমের পোলায়তো নেশা করে, আর স্বভাব চরিত্রও ততটা ভালো না!'
'শোনো, মানুষ চিরজীবন এক রকম থাকেনা, বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে'।
দুনিয়াটা বড় বৈচিত্রপূর্ণ, মানুষগুলো আরো বৈচিত্রময়, মন্টু আকাশ হতে পড়ে, কিসের সম্পর্ক? আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নাই। হাশেম তাচ্ছিল্যের সাথে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাক্ষাণ করে, একটা দিনমজুরের মেয়েকে ছেলের বউ বানানো অসম্ভব!
জমিরের মেয়েটা ইঁদুরের ঔষধ খেলো, আল্লাহর দয়ায় হাসপাতাল হতে বেচে ফিরেছে, তবে সারাক্ষণ ঝিমায়, উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে, তিনবার জিজ্ঞাসা করলে একটা কথার উত্তর পাওয়া যায়। চোখের সামনে মেয়েটা কেমন যেনো হয়ে গেছে, আচলে চোখ মোছে জমিরের বউ।
জমিরের সামনে ধু! ধু! অন্ধকার, ফ্যাকাসে ভবিষ্যৎ! বাড়ির সামনে বখাটে ছেলেদের আনাগোনা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে, রাতের বেলা টিনের চালে কারা যেনো ঢিল ছুড়ে মারে।
রাতে ভালো ঘুম হয়নাই, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, দাওয়ায় বসে আছে জমির, আজকে কাজে যেতে ইচ্ছে করছেনা।
জমির বাড়িতে আছো? বাহির হতেই হাক ছাড়ে আলিম মিয়া।
উঠে দাড়ায় জমির, ভাই কেমন আছেন? অনেক দিন এদিকটাতে আসেননা।
ব্যস্ত থাকিতো, তাই সময় পাচ্ছিনা, তা কেমন আছো? বউ বাচ্চা সবাই ভালো আছেতো?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তবে মেয়েটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়, রাতে কারা যেনো চালে ঢিল ছোড়ে, বাড়ির সামনে পোলাপান ঘুড়-ঘুড় করে।
শোনো, মেয়ের জন্য ভালো একটা প্রস্তাব এনেছি, ছেলে গার্মেন্টসে চাকরি করে, ভালো টাকা বেতন পায়, আচার ব্যবহার চমৎকার, বিয়ের পরে বউকে শহরে নিয়ে যাবে। চিন্তা করে দেখো, বিয়ে দিবে কিনা!
কি বলছেন আলিম ভাই, আপনি যেই ছেলে সম্পর্কে ভালো বলছেন, সেখানে আমাদের আপত্তি থাকবে কেনো? তবে সমস্যা হলো, ছেলেকি আমাদের অবস্থা জানে?
ও নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা, আমি সব খুলে বলেছি, আমার কথাতেই ছেলের পরিবার এই প্রস্তাবে মত দিয়েছে। আর বিয়ের খরচের ব্যাপারে তুমি চিন্তা করবানা। সব দায়িত্ব আমার।
ব্যাপক মেহমান এসেছে বিয়েতে, আলিম মিয়া ঘোশণা দিয়েছেন, নিজের মেয়ের বিয়েতে যতবড় অনুষ্ঠান করেছি, জমিরের মেয়ের বিয়েতেও ঠিক ততবড় অনুষ্ঠান হবে। দলে দলে গ্রামের মানুষ হাজির হচ্ছে।
জমিরের মেয়েটার সেই বিষন্ন ভাবটা আর নেই, যে চোখে ছিলো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন, সেই চোখেই আজ ভাসছে সুখস্বপ্ন! যে হৃদয় ছিলো চৈত্রের খাখা দুপুর, সেখানেই বইছে শ্রাবনের বাড়ি ধারা! সেই পুতুল খেলার বয়স হতেই প্রতিটি মেয়ের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকে ঘর বাধার স্বপ্ন, নিজের একটা সংসার, সুখী সংসার!
অসম্ভব রকম ব্যস্ত জমির উদ্দিন, চারিদিক হতে মেহমান আসছে, খাবার-দাবার নিয়ে সে এক এলাহী কান্ড। ছোট ছোট বাচ্চারা শোরগোল করে উঠলো, বড় এসেছে! বড় এসেছে!
কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা জমির উদ্দীন ব্যাকুল হয়ে ছুটে গেলো বড়ের গাড়ির দিকে। মেহমানদের যেনো কোন রকমের অসুবিধা না হয়, তারা যেনো বদনাম করতে না পারে। বড় পক্ষ অসন্তুষ্ট হলে শশুর বাড়ি হতে মেয়েকে খোঁটা শুনতে হয়, এটাই নিয়ম!
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পর্ব শুরু হচ্ছে, কাজী সাহেব খাতা খুলে লেখালেখির কাজ সম্পন্ন করে নিয়েছেন। অনুষ্ঠান স্থলে হাজির হলেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, নারী অধিকার সংগঠনের নেত্রী, ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট সহ নানা রকম এনজিও ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি।
জমির মিয়া ছুটে গেলেন, আরে চেয়ারম্যান সাহেব যে, আমার কি সৌভাগ্য, এই তোরা চেয়ার দে! লোকজন ছোটাছুটি করে চেয়ার এগিয়ে দিলো। গর্বে জমির উদ্দিনের বুক ফুলে উঠলো, এতো গুলো হোমড়া চোমড়া অফিসার সহ চেয়ারম্যান সাহেব তার মেয়ের বিয়েতে এসেছেন! নিশ্চই আলীম ভাইয়ের কাজ, আলীম ভাই দাওয়াত না দিলেতো তারা আসার কথা না।
আলিম মিয়া হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এলেন, উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, চেয়ারম্যান সাহেব আপনি? আর অফিসার সাহেবরাই বা কেনো?
নারী অধিকার সংগঠনের সভানেত্রি সামনে এগিয়ে এলেন, আপনারা এগুলো কি শুরু করেছেন? একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন? আপনাদেরতো পুলিশে দেয়া উচিত! ইউএনও সাহেবও এগিয়ে এলেন, সার্টিফিকেট অনুযায়ী মেয়ের বয়স ১৮হয়নি, ১৬বছর বয়সের মেয়েকে বিয়ে দেয়া যাবেনা, সে এখনো শিশু!
বড় যাত্রিরা একে একে বিদায় নিয়েছে, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে চাইছিলো। কত্তবড় সাহস, বাল্যবিবাহ দেয়! চেয়ারম্যানের অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেয়া হলো।
হতভম্ব আলিম মিয়া, হতভম্ব জমির উদ্দিন! নির্বাক দৃস্টিতে তাকিয়ে আছেন জমিরের বউ, বুক ভাঙা আর্তনাদ আর হাহাকারে বোধহয় আল্লাহর আরশও কেপে উঠছে।
জমিরের মেয়েটি একবার বোধহয় হেসে উঠেছিলো, তারপরেই জ্ঞান হারায়। লোকে বলাবলি করছে, জমিরের মেয়ে পাগল হয়ে গেছে!
১৬সেপ্টেম্বর২০১৩
No comments:
Post a Comment