পতিতাধিকার


এক।
ও আল্লাহরে.........
চিৎকারের শব্দটা বাতাসে ভেসে আসার আগেই মুখের উপর কঠিন এক লাথি এসে পড়ে। ছিটকে একপাশে পড়ে যায় জুলেখা। চুলের মুঠি ধরে, গড়ু পিটানোর মোটা লাঠি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করেই যায় হারিস আলী। জুলেখার চিৎকার ততক্ষণে থেমে গেছে, সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটি।
ফোস ফোস করে ভারী নিশ্বাস ফেলে, বাড়ি হতে ছুটে বেড়িয়ে যায় হারিস। অনেক পরিশ্রম হয়েছে, বউ পেটানো কম পরিশ্রমের কাজ নয়।

জমির বাড়ি আছস? দরজার সামনে দাড়িয়েই হাক ছাড়ে হারিস!
‘কে, হারিস নাকি? আয় দোস্ত ভিতরে আয়’।
‘না দোস্ত আজকে টাইম নাই, তোর কাছে একটা দরকারে আইছি। ৫০টা টাকা দেতো! আজকে রিক্সা নিয়া বাইর হইনাই। ওই শালীরে লইয়া আছি আরেক বিপদে!’
‘কার কথা কস, পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে জানতে চায় জমির’।
‘আর কার কতা কমু, আমার বউ! তালাক দিমু চিন্তা করতাছি, কিন্তু নারী নির্যাতন মামলা দিলেতো আবার জেলের ভাত খাইতে হইবো। তাই মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন উছিলায় মাইর ধইর করি। নিজের ইচ্ছায় গেলে ভালো, নাইলে মাঝে মইধ্যে এরম মাইর খাইবো!’ হাসিতে বত্তিশটা দাত বের হয়ে আসে হারিসের।

হারিসের দীর্ঘদিনের অপকর্মের সঙ্গী এই জমির, ছোট বেলা হতেই একসাথে বেড়ে ওঠা, তারুণ্যে একসাথে গ্রামের পাশের নিষিদ্ধপল্লীতে যাওয়া সব কাজে হারিস-জমির মানিক জোড়!
‘টাকা দিয়া কি করবি? ওদিকে যাবি নাকি, ইশারা করে জমির’।
‘হ! এক জিনিস আর ভালো লাগেনা, অরুচী লাগে। ত্রিশ টাকা দিয়া নিত্য-নতুন পাওয়া যায়......।
তুইও চল, অনেকদিন দুইজনে একসাথে যাইনা, উৎসাহী হয়ে প্রস্তাব করে হারিস’।
‘নাহ! আইজ যামুনা মন-দিল খারাপ! উদাস স্বরে জবাব দেয় জমির’।
‘কিরে তোর কি হইসে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চায় হারিস’।
‘কি আর হইবো, সবই কপালের দোষ! সফুরার বিয়া আবারো ভাইঙ্গা গেছে! জমিরের কন্ঠে হতাশা’।
এই নিয়া পরপর তিনবার সফুরার বিয়ে ভাঙলো, মা-বাপ মরা বোনের মুখের দিকে তাকাতে পারেনা জমির। গ্রামে নিষিদ্ধপল্লী আছে জানতে পারলেই ছেলে পক্ষ পিছিয়ে যায়, গ্রামের সব মেয়েকে খারাপ মেয়ে মনে করে।

হারিস একাই রওয়ানা হয়, জমিরের কাছ হতে ধার করা পঞ্চাশ টাকা ভাঙিয়ে একপ্যাকেট আকিজ বিড়ি এবং প্রমোদ বালার জন্য দুইটি খিলি পানও পকেটে গুজে নেয় হারিস। পথেই কোথাও দুপুরের খাবার খেয়ে নিবে।

দুই
বিছানায় মরার মতো পড়ে আছে জুলেখা, জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। হাত-পা নাড়ানোর অবস্থায় নেই, মাথাটা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। দুই হাতের কুনুইতে ভর করে একবার উঠতে চেস্টা করলো জুলেখা, সকাল হতে পেটে দানাপানি পড়েনাই, তার উপর স্বামীর মাইর! উঠেই কি হবে, ঘরে চাল নেই, চুলোয় আগুন জ্বলবেনা।
জুলেখা বিছানায় পরে রয়, হারিস আজ আসবে কিনা কে জানে। আসবেই বা কেনো, পকেটে নগদ তিনটি ১০টাকার নোট থাকলে ঘরের কি প্রয়োজন, বউয়ের কি দরকার!
জীবনের শত স্বপ্ন, স্বাদ-আহ্লাদ, সংসারের খুনসুটি, সুখ স্মৃতি ফোটা ফোটা অশ্রুকনা হয় ঝড়ে পড়ে জুলেখার চোখে।

সফুরা সুন্দর একটি রশি বানিয়েছে, পাটের রশি। নিজেদের জমিতে চাষ করা পাটের আঁশ দিয়ে নিপুণ দক্ষতায় অদ্ভুত সুন্দর এই রশিটি সব সময় সফুরার বালিশের পাশেই পড়ে থাকে। এই নিয়ে তিনবার সফুরার বিয়ে ভাঙলো, ব্যাপারটি নিয়ে সফুরার মধ্যে বিন্দুমাত্র হতাশা দেখা যাচ্ছেনা।
আলতো হাতে নিজের গলায় আঙুল বুলায় সফুরা, ছুয়ে দেখে পরম মমতায়। স্বামীর হাতের মালা যখন এই গলায় উঠলোনা, সময় সুযোগ করে রশিটিই না হয় একদিন গলায় জড়িয়ে নিবে!

তিন
দেশে বিরাট গন্ডগোল, সফুরার কলেজ পড়ুয়া মামাতো বোন আসমাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, সে নাকি এলাকার মেয়েদেরকে কোরআন শিক্ষা দিতো, জিহাদী বই পড়াতো। জুলেখার ভাইর ব্যাটা খালেদও গ্রেপ্তার হয়েছে, এলাকায় তাফসীর মাহফিলের আয়োজন করেছিলো বলে।

গ্রামের মানুষ কানাকানি করছে, জুলেখার বাপের বাড়ির মানুষ আর সফুরার মামার বাড়ির মানুষ নাকি খেপে গেছে। মাদ্রাসার হুজুরদের নিয়ে আন্দোলন করছে, প্রমোদ পল্লীটিকে উচ্ছেদ করতে হবে। আদালতের নির্দেশে প্রমোদ পল্লীর নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ! হারিস-জমিরদের বিনোদনের অধিকার রক্ষায় সদা তৎপর রাস্ট্র, নিজের দেহ বিক্রয় করে অর্থ উপার্জনের অধিকার রাস্ট্রের নারীদের রয়েছে।

অবশেষে জনতার প্রবল প্রতিরোধে ভেঙে যায় প্রমোদ পল্লী, আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয় রাস্ট্রীয় পতিতাধিকার।

চার
জুলেখা তার বসত ঘরটি নতুন করে গুছিয়ে নেয়। পুরাতন ছেড়া কাপড়গুলো ধুয়ে শুকোতে দিয়েছে, নিজেকেও পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়েছে। জুলেখা প্রহর গোনে, হারিস নিশ্চই আসবে। আজ,কাল অথবা পরশু, ফিরে তাকে আসতেই হবে!

তেল চুপচুপে চুলে নতুন করে খোপা বাধে সফুরা, চোখে একে দেয় গভীর কাজল রেখা। বিছানার পাশের সেই অদ্ভুত সুন্দর পাটের রশিটা নেই, একটি কাগজের ফুলই কেবল পড়ে আছে শূণ্যস্থানে। সফুরা স্বপ্ন দেখেছে, সাদা একটি ঘোড়ায় চড়ে অদ্ভুত সুন্দর এক রাজপুত্র ছুটে আসছে। ঘোড়ার খুড়ের টগ-বগ, টগ-বগ শব্দে সফুরার ঘুম ভেঙে যায়।

হারিস-জমিররা ইদানিং মানব বন্ধন করছে, প্লাকার্ড নিয়ে মিছিল করছে। পতিতাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবীতে চমৎকার সব ব্যানার ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে তাদের হাতে। দাবী একটাই, যথাযথ পূণর্বাসনের আগ পর্যন্ত অবাধ বিনোদনের নিশ্চয়তা চাই।

Post Comment

No comments:

Post a Comment