দোয়ার রি-এ্যাকশন!!


আমার বন্ধু আলী, পুরো নাম আলী আহম্মদ। চিন্তা চেতনায় যোজন যোজন দূরত্ব সত্বেও চরম বন্ধুত্ব দু’জনের মধ্যে। আমি যেমন চিন্তা চেতনায় একশো পার্সেন্ট আলবদর, অন্যদিকে আলী হচ্ছে একশ পার্সেন্ট শাহবাগী।
নাহ! আলী’কে শাহবাগী বলা যাবেনা, শত হলেও নিজের বন্ধু, বন্ধুকে শাহবাগী বলে গালী দেয়া ঠিক হবেনা! বরং বলা যায় চিন্তা চেতনায় শতভাগ মুক্তিযোদ্ধা।
মুখ থেকে ভুস ভুস করে সিগারেটের ধোয়া ছাড়া আলীর প্রিয় হবির মধ্যে একটা, অন্যদিকে সিগারেটের ধোয়া নাকে ঢুকলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
গার্লফ্রেন্ড লালন পালন আর হাতি লালন পালন করা একই কথা, এই কাজটি নিরলস ভাবে অতীব যত্নের সাথে সম্পাদন করে যাচ্ছে আমার এই বন্ধুটি। অন্যদিকে এই কাজটিকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং ফালতু কর্ম আখ্যায়ীত করে, একশ হাত দূরত্ব বজায়ে রাখার চেস্টায় সদা নিমগ্ন আমি।

সেদিন এমবিএ’র থিসিস রিলেটেড একটি কাজে গিয়েছিলাম আলীর বাসায়, গিয়েতো আমি থ!
‘কিরে তুই আবার রাজাকার বাহিনীতে জোগ দিলি কবে?’
বত্রিশ পাটি দাত বের করে আলী হাসছে, হাসিটা ভেতর হতে আসছিলোনা, বুঝাই যাচ্ছিলো প্রাণহীন হাসি! মুখ ভর্তি দাড়ি-গোফের জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে।
চেহারার এই অবস্থা কেনো? তোর সাথে হাটলেতো আমাকে পুলিশে ধরবে! ঠাট্টা করেই বললাম।
আলী আবার হাসে, কেনো পুলিশে ধরবে কেনো?
‘আমি খাটি আলবদর হয়েও ক্লিন সেভড, অথচ তোর মুখ দাড়ি গোফে ভর্তি! না তোর সাথে আর চলা যাবেনা! নিশ্চিত একদিন শিবির করার অভিযোগে তোকে সহ আমাকে রাস্তা হতে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে’।
আলি এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

ঝটপট রেডি হয়ে আলী আমাকে নিয়ে ঘর হতে বের হলো।
দোস্ত তোর সাথে অনেক কথা আছে, আলীর কন্ঠে উদ্বেগ ঝড়ে পড়ছে। আলীর বাসায় আসলেই আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য পাড়ার সোহেলের দোকান। দারুন খাতির হয়ে গেছে সোহেলের সাথে, আমাদের দেখেই হৈ হৈ করে উঠলো সোহেল।
একটা সিগারেট নিয়ে আমার সামনেই ধীরে সুস্থে সেটা টানছে আলী, আমি কি করবো! অলস ভঙ্গিত একটা সেন্টার ফ্রুইট নিয়ে চিবোতে থাকলাম।
‘তোকে না কতদিন বলেছি, আমার সামনে বসে সিগারেট টানবিনা! বিশ্রী গন্ধ, এগুলাও মানুষে খায় ছি!’
আমি সিগারেট খাইলে গন্ধ হয়না, দেখবি? বলেই আলী একগাদা ধোয়া ছেড়ে দিলো আমার মুখ লক্ষ করে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আলী, মনে হচ্ছে বিশাল এক রসিকতা করে ফেলেছে।
চরম বিরক্তি নিয়ে আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। শালা! তোর মতো বন্ধু থাকলে আর শত্রুর দরকার হয়না, মনে হচ্ছে জুতা খুইলা মোজা দিয়ে তোরে ইচ্ছে মতো পিটাই!
আলী হাসে, সেই বিখ্যাত বত্রিশ দাত বিস্তৃত হাসি!

কিছুক্ষণ যেতেই আলী নীরব হয়ে যায়, একে একে বর্ণনা করে দুঃখগুলো। চেহারার এই অবস্থার হেতু এবার বুঝতে পারি। গার্লফ্রেন্ডের পরিবারে তাদের এই রিলেশন নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছে, টেনশনে বেচারা নাওয়া খাওয়া ভুলে দেবদাস দেবদাস ভাব। ভাতের বদলে এখন নিয়ম করে তিনবেলা সিগারেট খায়। সর্বশেষে আলী রিকোয়েস্ট করে, দোস্ত নামাজ পড়ে আমাদের জন্য একটু দোয়া করবি, যেনো ঝামেলাটা ঠিকঠাক মতো মিটে যায়।
আমি সহানুভূতির স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, কি দোয়া করবো?
‘দোয়া করবি যেনো আমার আর ওর মাঝে যেসব ঝামেলা আছে সেগুলো দূর হয়ে যায়। আমি যেনো ওকে পাই। ইত্যাদি ইত্যাদি’
‘ঠিক আছে দোয়া করবো, তবে একটা শর্ত আছে’।
‘কি শর্ত?’
‘শর্ত হচ্ছে দোয়ায় রি-এ্যাকশন খারাপ কিছু হলে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবিনা!’
‘ওই! আন্ধারে হাইকোর্ট দেখাস? আমার সাথে মশকারী করস! দোয়ার আবার রি-এ্যাকশন আছে?’
‘তোর বিশ্বাস হচ্ছেনা? আচ্ছা তাহলে তোকে দু’টি ঘটনা বলছি, শোন।’
আলীর আবার ভালো একটা গুন আছে, সেটা হচ্ছে মনযোগী শ্রোতা। যাই বলিনা কেনো, আলী অত্যান্ত মনযোগ সহকারে শোনার চেস্টা করে। আমি শুরু করলাম।

প্রথম ঘটনাঃ এক বৃদ্ধা মহিলা তপ্ত মরুর বুকে হাটছে, গন্তব্য এখনো বহুদূর। হাটতে হাটতে ক্লান্ত মহিলা আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমাকে একটা উট দান করো। মহিলা হাটছেন আর দোয়া করছেন, আল্লাহ তার দোয়া কবুল করছেননা। একপর্যায়ে অধৈর্য হয়ে মহিলা আবার দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! উট না দিলে একটা উটের বাচ্চা হলেও দান করো! আল্লাহ এবার তার দোয়া কবুল করলেন।
ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলো এক বাণিজ্য কাফেলা, হঠাৎ করেই কাফেলার একটি উটনী বাচ্চা প্রসব করলো। কাফেলার সর্দারতো মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন! একদিকে উটের বাচ্চা নেয়ার মতো পর্যাপ্ত বাহন কাফেলায় নেই, অন্যদিকে মরুভূমিতে এটা ফেলে যাওয়াও বোকামী হবে, বাজারে নিয়ে এটা বিক্রয় করলে বেশ লাভবান হওয়া যাবে।
হঠাৎ করেই কাফেলার সর্দার ওই বৃদ্ধাকে দেখতে পেলেন, যিনি উটের বাচ্চার জন্য দোয়া করেছিলেন। সর্দার জোড় করেই উঠের বাচ্চাটিকে বৃদ্ধার কাধে তুলে দিলেন। হুকুম করলেন, এটা নিয়ে আমাদের সাথে সাথে আসো!
শিক্ষাঃ ওই বৃদ্ধা মরুভূমিতে চলতে গিয়ে আল্লাহর কাছে পথ চলার বাহন চাননাই, তিনি চেয়েছিলেন উট কিংবা উটের বাচ্চা। আল্লাহ তাকে উটের বাচ্চাই দান করেছিলেন, পথ চলার বাহন দান করেননাই।

ইতোমধ্যেই সোহেল চা বানিয়ে দিয়েছে, চমৎকার চা বানায় ছেলেটি! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমার দ্বিতীয় ঘটনা শুরু করলাম। মনযোগী শ্রোতার মতো আলী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

দ্বিতীয় ঘটনাঃ আমাদের এলাকার জিকু ভাই, নাম শুনেছিস নিশ্চই? কয়েকবার তার ব্যাপারে তোর সাথে আলোচনা করেছিলাম আমাদের প্রজেক্টের ব্যাপারে, যাই হোক মূল টপিক্সে আসি।
জিকু ভাইয়ের ছোট বেলার কথা, জিকু ভাই সাইজে আমার সমানই, মানে বেটে খাটো মানুষ। হঠাৎ করেই একদিন রাতের বেলা, গ্রামের বাড়িতে জিকুভাই ও তার কয়েকজন সমবয়সী ছেলে দৌড় প্রতিযোগীতা শুরু করলো, কার আগে কে গন্তব্যে পৌছতে পারে। দূর্ভাগ্যবশত একমাত্র জিকুভাই গন্তব্য পৌছতে পেরেছিলো, বাকি দুইজন মাঝ পথ থেকেই আউট!
‘মাঝ পথে থেকেই আউট মানে? আর গন্তব্যে পৌছানোটা দূর্ভাগ্য হবে কেনো? সেটাতো সৌভাগ্য! আলীর কথায় যুক্তি ঝড়ে পড়ে’।
আমি আবার শুরু করি, গ্রামে সাধারণতো বাড়ির সামনের উঠুনে রশি টানিয়ে সেখানে কাপড় শুকাতে দেয়া হয়। জিকু ভাইয়ের বাকি দুই কম্পিটিটর ছিলো তার তুলনায় বেশ লম্বা! অন্ধকারে দৌড় দিতেই ওই রশির সাথে গলা আটকে তারা ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়, অন্যদিকে সাইজে ছোট হওয়ায় জিকুভাই রশির নিচ দিয়েই অবলিলায় গন্তব্যে পৌছে যায়, মাথার কিঞ্চিত উপরেই যে রশি আছে সেটা জিকুভাই অনুভবই করেনাই।
আলী এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, হাসির দমকে হাতের কাপ হতে চা পড়ে যাচ্ছে সেদিকে নজর নেই।
হাসি থামতেই আমি আবার শুরু করি, রশির সাথে গলা বেধে দুইবন্ধুর পড়ে যাওয়া এবং রশির নিচ দিয়ে জিকু ভাই পার হয়ে যাওয়া, ব্যাপারটি জিকু ভাইয়ের কাছে চরম অবমাননাকর মনে হয়।
জিকু ভাই আল্লাহর কাছে দোয়া করে, হে আল্লাহ! আমি সাইজে ছোট, তুমি অতি দ্রুত এমন ব্যবস্থা করো, যেনো ওই রশি আমার গলায় লাগে। আল্লাহ জিকু ভাইয়ের দোয়া কবুল করেছিলো।
সপ্তাহ খানিক পরে, এক সন্ধায় জিকুভাই উঠোনে দৌড়া দৌড়ি করছিলো, হঠাৎ করেই ওই রশির সাথে জিকু ভাইয়ের গলা এমনভাবে ধাক্কা খায়, ফাঁসি খাওয়ার মতো অবস্থা প্রায়। ব্যাপার যেটা তাহচ্ছে, রশিটা যেই বাশের সাথে বাধা ছিলো, সেই বাশ কোন এক কারনে হেলে পড়ে রশি নিচু হয়ে গিয়েছিলো।
শিক্ষাঃ জিকু ভাই লম্বা হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেননাই, তিনি দোয়া করেছিলেন গলায় রশি লাগার জন্য। আল্লাহ তার গলায় রশি লাগানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

‘ঘটনা শুনে চিন্তিতভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আলী, তুই কি বোঝাতে চাস সেটা স্পষ্ট করে বল’।
‘আমি যেটা বোঝাতে চাই সেটা বেশ সিম্পল, তোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তুই কি চাস!’
‘মানে কি?’
‘মানে হচ্ছে, তুই কি তোর গার্লফ্রেন্ডকে চাস? নাকি তোর সাংসারীক জীবন সুখী হবে, বাকি জীবন সুখে শান্তিতে কাটাতে পারবি এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাস?
দ্রুত সিদ্ধান্তনে, সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানা। তুই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে যে দোয়া করতে বলবি, আমি সেই দোয়াই করবো। দোয়া কবুল হবে কিনা জানিনা, তবে উল্টাপাল্টা দোয়া কবুল হয়ে গেলে কিন্তু পরে পস্তাতে হবে! তোর এই গার্লফ্রেন্ড কিন্তু জিকু ভাইয়ের মতো তোর গলায় রশি কিংবা ওই বৃদ্ধার উটের মতো তোর ঘাড়ে চেপে বসতে পারে!’

চিন্তিত ভঙ্গিতে আলী বসে আছে, তার মুখে কোনো কথা নাই। দোস্ত আজকে বাদ দে! আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা, আমার কি চাওয়া দরকার। তবে তোর গল্প শুনে গার্লফ্রেন্ড সংক্রান্ত দূশ্চিন্তা নাই হয়ে গেছে! আমার মনে হচ্ছে, এভাবে দোয়া করা উচিত। “হে আল্লাহ! তুমি আমার কল্যান করো! কিসে আমার কল্যান, কিসে আমার অকল্যান সেটা আমি জানিনা। তুমি আমার জন্য যেটা কল্যানকর মনে করো সেটাই কর। যাবতীয় অকল্যান হতে আমাকে হেফাজত করো।”

২৭জুলাই২০১৩

Post Comment

No comments:

Post a Comment