শোনো মিয়ারা এই দেশের মূল সমস্যা হইলো গিয়া মানুষ! হাটে মাঠে তুমি যেখানেই যাইবা দেখবা মানুষ। এতো মানুষ কি খায়? কই ঘুমায়? রাস্তায় জ্যাম লাইগাই থাকে।
মানুষ যদি কনট্রোল করা যায়, তাইলে মনে করো এই দ্যাশ সোনার বাংলায় পরিণত্ হইবো।
চারিদিকে সম্মতি সূচক রব ওঠে, ‘হ! হ! ঠিকই কইছেন চ্যারমান সাব!’
আমি ঠিক নাকইলে, ঠিক কতা কইবো কেডা? ওই গমচোর কলিম উদ্দিন কইবো?!
আমি চেয়ারম্যান হওনের পর গম চুরি করছি? বাঘের মতো গর্জন করে উঠেন সাদেক মৃধা।
শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠলো, না না চ্যারমান সাব, আপনার লাহান ভালা মানুষ অয়না। আপনি আছেন বইলাইতো আমরা দুই বেলা খাইতে পারি। আপনি অইলেন গিয়া আমাগো বাঘা চ্যারমান।
হই মিয়া চাইয়া রইছো ক্যা, সবাইরে চা দ্যাও, আব্দুর রহিমের দিকে তাকিয়ে মৃদু ধমক দেয় চেয়ারম্যান সাদেক মৃধা। বুঝা যাচ্ছে সাদেক মৃধা আজ বেশ খোশ মেজাজে রয়েছেন।
মাঝ বয়সী আব্দুর রহীম চায়ের কাপে ঝড় তুলে, টুং টাং, টুং টাং কাপের সাথে চামচের সংঘর্ষ হয়। উৎসুক শ্রোতারা লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাপের দিকে।
শোনো মিয়ারা এইযে এইখানে আব্দুর রহীমের চায়ের দোকানের সামনে এখন তোমরা কতজন মানুষ আছো? আবার কথা শুরু করেন সাদেক মৃধা।
একজন উঠে দাঁড়িয়ে মাথা গুনে, আমরা ২০জন আছি।
এই বটতলা বাজারে সব মিলিয়ে কতজন মানুষ অইবো?
শ্রোতাদের একজন মাথা চুলকায়, তার দৃষ্টি চায়ের কাপের দিকে, কম কইরা হইলেও হাজার খানিকতো অইবোই।
এইবার বুঝো, মানুশ বেশি হইলে কি কি সমস্যা অয়! জিনিসপত্র কেনার জন্য কাড়াকাড়ি অয়, বাড়তি দাম দিয়া জিনিস কেনা লাগে। যদি কাস্টমার কম অইতো তাইলে কিন্তু এতো বেশি দামে জিনিসপত্র কেনা লাগতোনা।
এইডা কি কন চ্যারমান সাব, কাস্টমার না থাকলে আমি বেচমু কেমনে? খামু কি? না না, মানুষ বেশি হওয়া ভালো, মানুষ বেশি থাকলে বেচা বিক্রি ভালো অয়। আমতা আমতা করে জবাব দেয় আব্দুর রহিম।
খেকিয়ে উঠেন চেয়ারম্যান, তুমি মিয়া কি বুঝবা, অশিক্ষিতের মতো কতা কও ক্যা? তুমি তখন কম দামে জিনিসপত্র কিনতে পারবা, কমদামে বিক্রি করতে পারবা। তোমারতো ক্ষতি হইবোনা। আব্দুর রহীমকে আশ্বস্ত করার চেস্টা করেন, সাদেক মৃধা।
ক্ষতি হইবোনা কেমনে কইলেন, এখন আমি যদি দৈনিক ১০০কাপ চা বেচি, মানুষ কম থাকলেতো ৫০কাপও বেচতে পারুমনা!
শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, না না এইটা ঠিক অইবোনা চ্যারমান সাব, তাইলে মানুষ বেশি হওনই ভালা।
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে সাদেক মৃধার কপালে, এই অশিক্ষিত মানুষগুলারে দুইটা জ্ঞানের কথা শুনাইবো, সেই উপায় নাই, কি সব উলটাপালটা কথা বলে, বিব্রত করে দেয়।
মাথার উপর বটগাছের পাতার মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়, কোথা থেকে চুন এসে পড়ে সাদেক মৃধার হাতের হাতের উপর। কা কা করে উড়ে যায় কাক।
মোটা ফ্রেমের চশমাটা মুছতে মুছতে, চেচিয়ে উঠলেন সাদেক মৃধা, এই!পান খায় কেরে?
চুন না চ্যারমান সাব, এইডা কাউয়ার কাম। একজন পানি ভর্তি জগ নিয়ে ছুটে আসে।
হাত ধুতে ধুতে আবার কথা শুরু করে চেয়ারম্যান, এইযে দেখো আমেরিকা, ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, তারা অনেক ধনী রাষ্ট্র, আমাগো দ্যাশের মানুষ হেই দেশে যায় কামলা খাটতে। কতা ঠিক কিনা?
হ, কতা ঠিক চ্যারমান সাব, সমস্বরে সম্মতি জানায় উপস্থিত শ্রোতারা।
তারা ধনী অইলো কিভাবে? এইটা অইছে গিয়া তাগো দেশে মানুষ কম কিন্তু সম্পদ বেশি, হেই সম্পদ কাজে লাগাইয়া তারা এখন অনেক ধনী অইছে, বহু মিল-কারখানা তৈরী করছে।
এইডা কি হুনাইলেন চ্যারমান সাব, আমিতো হুনছি হেগো দেশে মানুষ নাই দেইখা হেরা সমস্যায় পইরা গেছে। হেগো মিলকারখানা চালাইতে পারতাছেনা। সিঙ্গাপুরে নাকি সরকার ঘোশণা দিছে, দুইটার বেশি সন্তান নিলে পুরস্কার দিবো। পিঠ চুলকাতে চুলকাতে প্রশ্ন করে চাষীদের একজন।
আরেকজন তাকে সমর্থন জানায়, ‘হ চ্যারমান সাব, আমি নিজেও হুনছি, কোরিয়াতে নাকি সরকার কইছে একটার বেশি বাচ্চা নিলে সরকারী সুযোগ সুবিধা বাড়াইয়া দিবো’।
চেয়ারম্যানের চোখ থেকে অগ্নিদৃষ্টি ঝড়ে পড়ে, চুপসে যায় উপস্থিত শ্রোতারা। এই মিয়ারা তোমাগো পড়ালেহা কতদূর? কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়ছো?
শ্রোতার নিশ্চুপ, কারো মুখে কথা নেই,
তোমরা বেশি বুঝো, নাকি আমি বেশি বুঝি?
আপনি শিক্ষিত মানুষ আপনি বেশি বুঝেন,
তাইলে আমার কথা শেষ করতে দাও, কতা না হুইন্নাই কতা কও ক্যা?
রাগে গজ গজ করতে থাকেন চেয়ারম্যান, এইযে দেখো আমাগো দেশে সম্পদ নাই, খাদ্যের অভাব। আমাগো দেশে যদি মানুষ কম হইতো তাইলে কি সম্পদের অভাব হইতো? যা আছে তা দিয়াই আমরা আরাম করে থাকতে পারতাম, এখন মানুষ বেশি, চাহিদা বেশি।
একজন হাত তুলে চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে,
তুমি আবার কি কইবা?
চ্যারমান সাব, আমাগো দেশে মানুষ বেশি হওয়াতেতো আমাগো ভালোই অইছে। যেমন ধরেন, আল্লায় আমাগো দেশে সম্পদ দেয়নাই, কিন্তু মানুষ দিছে, আবার ধণী রাষ্ট্র গুলাতে সম্পদ দিছে কিন্তু মানুষ দেয়নাই।
এখন আমাদের দেশে যে অতিরিক্ত মানুষ আছে সেগুলারে যদি ট্রেনিং দিয়া ধণী রাষ্ট্রে পাঠাইয়া দেই, তাইলেতো তারা সেখানে গিয়া টাকা পয়সা কামাই কইরা দেশে পাঠাইতে পারে। এইডা আমাগো লাভ।
আবার দেখেন, পোশাক তৈরী এবং রপ্তানিতে আমাগো দেশ ফাস্ট অইছে, আমাগো দেশে মানুষ যদি বেশি না অইতো তাইলে কি এইডা সম্ভব অইতো?
তাছাড়া ধনী রাষ্ট্রগুলা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক উন্নত, আমরাও যদি শিক্ষাদিক্ষায় উন্নত অইতে পারি, তাইলেতো আমাগো দেশও ধনী অইয়া যাইবো। নতুন নতুন মেশিন আবিস্কার অইবো, মিলকারখানা অইবো, আমাগো দেশে অনেক মানুষ আছে, বিদেশ থিকা মানুষ আনা লাগবোনা, নিজেগো মানুষ দিয়াই বাংলাদেশ ধনী অইয়া যাইতে পারবো।
তোমার কতায় যুক্তি আছে, সম্মতি সূচক মাথা ঝুলায় সাদেক মৃধা। তা কতা কইলেইতো অইলোনা, ধণী রাষ্ট্রগুলার মতো আমাগো পোলাপানরে শিক্ষা দেয়ার মতো টাকা কি আমাগো আছে?
তাদের মতো টাকা নাই ঠিকই, তবে যা আছে হেইডাওতো চুরি অইয়া যাইতাছে। শুনলাম, কাগজে কলমে আমাগো স্কুল বিল্ডিং হওয়ার কতা আছিলো তিনতলা, এখন দেখি অইছে দুই তলা। আরেক তলার টাকা কই গেছে?
আবার হুনলাম, শিক্ষামন্ত্রী নাকি আমাগো দেশে সস্তায় বই না ছাপাইয়া, বেশি টাকা দিয়া ভারতে বই ছাপাইতে দিছে, কমিশন খাওয়ার লোভে। আর আমাগো দেশের প্রেস মালিকরা কাজ না পাইয়া প্রেস বন্ধ করে দিতাছে।
খুক খুক করে কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করলেন চেয়ারম্যান সাদেক মৃধা, হেইডা ভিন্ন প্রসঙ্গ! ওগুলা তোমরা বুঝবানা। তোমরা অইছো গিয়া কুয়ার ব্যাঙ, কুয়ার ব্যাঙ বুঝো? কুয়ার ব্যাঙ কুয়ারেই বিশ্ব মনে করে, দুনিয়ার আর কোনো কিছু তাদের বুঝাইলেও বুঝেনা। তোমাগো পড়ালেখা কম এগুলা তোমরা বুঝবানা।
সাদেক মৃধা দ্বিধায় পড়ে যায়, এই অশিক্ষিত মানুষগুলাকে কিভাবে বুঝাবে জনসংখ্যা সমস্যা হচ্ছে এদেশের প্রধান সমস্যা। বাড়তি জনসংখ্যা সমস্যার কারণেই এদেশ পিছিয়ে রয়েছে।
পানের কৌঠা ভর্তি খিলি পান থেকে চট করে একটা মুখে পুড়ে দেয় সাদেক মৃধা। নাহ! ছোট বউয়ের হাতে যাদু আছে, দারুন পান বানায়।পানতো নয় যেনো মধু!
আচ্ছা তোমাগো একটা উদাহরণ দেই, নড়ে চড়ে বসে শ্রোতারা, মনে মনে কথা গুছিয়ে নেন চেয়ারম্যান। এইযে হারিছ উদ্দিন তার পোলারে কোলে করে বসে আছে। এই পোলার বয়স কতো?
হারিছ মিয়া পরম মমতায় ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জবাব দেয়, ৫বছর চ্যারমান সাব, আল্লাহ দিলে ব্রেন অনেক ভালো।
তোমার পোলা মাইয়া কয়ডা?
আল্লায় দিলে ৬জন চ্যারমান সাব।
আচ্ছা তোমার মাসিক ইনকাম কতো?
দশ-বারো হাজার টাকার মতো রোজগার করি।মাথা নিচু করে জবাব দেয় হারিস মিয়া।
এই ইনকাম দিয়ে এতোবড় পরিবার চালাতে তোমার কষ্ট অয়না? নিজের যুক্তির দিকে আত্মবিশ্বাসী ভাবে এগিয়ে যান সাদেক মৃধা।
একটু কষ্ট অয়, তারপরেও আল্লার কাছে শুকরিয়া, আল্লায় ভালোই রাখছে।
ধরো তোমার পোলা-মাইয়া মাত্র দুইটা, তাইলে এই ইনকামে তোমার সংসার এরচাইতে ভালো চলতোনা?
ছেলেটিকে বুকে চপে ধরে মাথা নিচু করে থাকে হারিস মিয়া।
নিজের মনেই মৃদু হেসে ওঠে সাদেক মৃধা, বিজয়ের আভা চোখে মুখে। দেখলাতো মিয়ারা, জনসংখ্যা যে আমাদের একটা বিরাট সমস্যা হেইডা এইবার বিশ্বাস অইছে?
মৃদু স্বরে প্রতিবাদ করে ওঠে হারিস মিয়া, আমার পোলা-মাইয়াগুলা আল্লাহ দিছে, আবার আমার এই আয়ের টাকাও আল্লায় দিছে। আমার পোলা-মাইয়া যদি দুইডা অইতো তাইলে যে এরচাইতে কম ইনকাম অইতোনা হেইডা আমি কেমনে কমু? রিজিকের মালিক আল্লাহ!
ও এখন আল্লাহ’র কথা কও? আল্লায় কি তোমারে সাত-আটটা পোলা-মাইয়া নিতে কইছে? এখন এই পোলা-মাইয়া গুলানরে মানুষ করবা কেমনে? সবগুলাতো মূর্খ অইবো! তুমি ভুল করছো হেইডা স্বীকার করো।
না, মূর্খ অইবোনা, ওগোরে স্কুলে ভর্তি করছি, সবগুলা উচ্চশিক্ষিত অইবো, প্রতিবাদ জানায় হারিস মিয়া।
শুনছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি হের বাবা-মায়ের চৌদ্দ নম্বর পোলা। চিন্তা কইরা দেখেন, যদি হের বাবা-মা দুইটা সন্তান জন্মের পরেই আপনার এই বক্তব্য শুনতো তাইলে রবীন্দ্রনাথের জন্ম অইতো?
হারিসের কথা শুনে, উচ্চস্বরে হেসে ওঠে উপস্থিত শ্রোতারা। হারিছ মিয়া কতাডাতো মিছা কয়নাই চ্যারমান সাব।
থামো তোমরা! খেকিয়ে উঠেন সাদেক মৃধা। এতো হাইসোনা! কই আগরতলা, আর কই চোকীর তলা! তোমার পোলায় কি রবীন্দ্রনাথ অইবো নাকি?
উঠে দাড়ায় হারিস মিয়া, চ্যারমান সাব, বাড়িতে ম্যালা কাম পইরা আছে, এখন যাইতে অইবো।
যাওয়ার আগে একটা কতা কই, আপনারাতো ছয় ভাই, ভাইগো মইধ্যে আপনিই ছোড, আপনার মরহুম আব্বা হুনছি আপনাগো নিয়া অনেক পরিশ্রম করছে, অনেক কষ্টে আপনার ভাইগো মানুষ করছে।
মরহুম পিতার কথা মনে হতেই আবেগে চোখের পানি চলে আসলো চেয়ারম্যান সাদেক মৃধার। রুমালে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, তুই ঠিকই শুনেছিস, আমার আব্বার মতো মানুষই অয়না।
আচ্ছা চ্যারমান সাব, আপনিতো ছয় নম্বর পোলা, আপনার বাবায় কি আপনারে জন্ম দিয়া ভুল করছিলো?
জবাবের অপেক্ষা করেনা হারিস মিয়া। ছেলেকে কাঁধে চাপিয়ে বাড়ির দিকে হাটা দেয়। বিশাল কাঁধে চরে বাবার মাথার চুল নিয়ে খেলা করে হারিসের ছেলে।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাদেক মৃধা। অস্ফুট স্বরে মুখ হতে বেরিয়ে আসে, মূর্খ! মূর্খ!
২৬জানুয়ারী২০১৪
মানুষ যদি কনট্রোল করা যায়, তাইলে মনে করো এই দ্যাশ সোনার বাংলায় পরিণত্ হইবো।
চারিদিকে সম্মতি সূচক রব ওঠে, ‘হ! হ! ঠিকই কইছেন চ্যারমান সাব!’
আমি ঠিক নাকইলে, ঠিক কতা কইবো কেডা? ওই গমচোর কলিম উদ্দিন কইবো?!
আমি চেয়ারম্যান হওনের পর গম চুরি করছি? বাঘের মতো গর্জন করে উঠেন সাদেক মৃধা।
শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠলো, না না চ্যারমান সাব, আপনার লাহান ভালা মানুষ অয়না। আপনি আছেন বইলাইতো আমরা দুই বেলা খাইতে পারি। আপনি অইলেন গিয়া আমাগো বাঘা চ্যারমান।
হই মিয়া চাইয়া রইছো ক্যা, সবাইরে চা দ্যাও, আব্দুর রহিমের দিকে তাকিয়ে মৃদু ধমক দেয় চেয়ারম্যান সাদেক মৃধা। বুঝা যাচ্ছে সাদেক মৃধা আজ বেশ খোশ মেজাজে রয়েছেন।
মাঝ বয়সী আব্দুর রহীম চায়ের কাপে ঝড় তুলে, টুং টাং, টুং টাং কাপের সাথে চামচের সংঘর্ষ হয়। উৎসুক শ্রোতারা লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাপের দিকে।
শোনো মিয়ারা এইযে এইখানে আব্দুর রহীমের চায়ের দোকানের সামনে এখন তোমরা কতজন মানুষ আছো? আবার কথা শুরু করেন সাদেক মৃধা।
একজন উঠে দাঁড়িয়ে মাথা গুনে, আমরা ২০জন আছি।
এই বটতলা বাজারে সব মিলিয়ে কতজন মানুষ অইবো?
শ্রোতাদের একজন মাথা চুলকায়, তার দৃষ্টি চায়ের কাপের দিকে, কম কইরা হইলেও হাজার খানিকতো অইবোই।
এইবার বুঝো, মানুশ বেশি হইলে কি কি সমস্যা অয়! জিনিসপত্র কেনার জন্য কাড়াকাড়ি অয়, বাড়তি দাম দিয়া জিনিস কেনা লাগে। যদি কাস্টমার কম অইতো তাইলে কিন্তু এতো বেশি দামে জিনিসপত্র কেনা লাগতোনা।
এইডা কি কন চ্যারমান সাব, কাস্টমার না থাকলে আমি বেচমু কেমনে? খামু কি? না না, মানুষ বেশি হওয়া ভালো, মানুষ বেশি থাকলে বেচা বিক্রি ভালো অয়। আমতা আমতা করে জবাব দেয় আব্দুর রহিম।
খেকিয়ে উঠেন চেয়ারম্যান, তুমি মিয়া কি বুঝবা, অশিক্ষিতের মতো কতা কও ক্যা? তুমি তখন কম দামে জিনিসপত্র কিনতে পারবা, কমদামে বিক্রি করতে পারবা। তোমারতো ক্ষতি হইবোনা। আব্দুর রহীমকে আশ্বস্ত করার চেস্টা করেন, সাদেক মৃধা।
ক্ষতি হইবোনা কেমনে কইলেন, এখন আমি যদি দৈনিক ১০০কাপ চা বেচি, মানুষ কম থাকলেতো ৫০কাপও বেচতে পারুমনা!
শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, না না এইটা ঠিক অইবোনা চ্যারমান সাব, তাইলে মানুষ বেশি হওনই ভালা।
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে সাদেক মৃধার কপালে, এই অশিক্ষিত মানুষগুলারে দুইটা জ্ঞানের কথা শুনাইবো, সেই উপায় নাই, কি সব উলটাপালটা কথা বলে, বিব্রত করে দেয়।
মাথার উপর বটগাছের পাতার মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়, কোথা থেকে চুন এসে পড়ে সাদেক মৃধার হাতের হাতের উপর। কা কা করে উড়ে যায় কাক।
মোটা ফ্রেমের চশমাটা মুছতে মুছতে, চেচিয়ে উঠলেন সাদেক মৃধা, এই!পান খায় কেরে?
চুন না চ্যারমান সাব, এইডা কাউয়ার কাম। একজন পানি ভর্তি জগ নিয়ে ছুটে আসে।
হাত ধুতে ধুতে আবার কথা শুরু করে চেয়ারম্যান, এইযে দেখো আমেরিকা, ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, তারা অনেক ধনী রাষ্ট্র, আমাগো দ্যাশের মানুষ হেই দেশে যায় কামলা খাটতে। কতা ঠিক কিনা?
হ, কতা ঠিক চ্যারমান সাব, সমস্বরে সম্মতি জানায় উপস্থিত শ্রোতারা।
তারা ধনী অইলো কিভাবে? এইটা অইছে গিয়া তাগো দেশে মানুষ কম কিন্তু সম্পদ বেশি, হেই সম্পদ কাজে লাগাইয়া তারা এখন অনেক ধনী অইছে, বহু মিল-কারখানা তৈরী করছে।
এইডা কি হুনাইলেন চ্যারমান সাব, আমিতো হুনছি হেগো দেশে মানুষ নাই দেইখা হেরা সমস্যায় পইরা গেছে। হেগো মিলকারখানা চালাইতে পারতাছেনা। সিঙ্গাপুরে নাকি সরকার ঘোশণা দিছে, দুইটার বেশি সন্তান নিলে পুরস্কার দিবো। পিঠ চুলকাতে চুলকাতে প্রশ্ন করে চাষীদের একজন।
আরেকজন তাকে সমর্থন জানায়, ‘হ চ্যারমান সাব, আমি নিজেও হুনছি, কোরিয়াতে নাকি সরকার কইছে একটার বেশি বাচ্চা নিলে সরকারী সুযোগ সুবিধা বাড়াইয়া দিবো’।
চেয়ারম্যানের চোখ থেকে অগ্নিদৃষ্টি ঝড়ে পড়ে, চুপসে যায় উপস্থিত শ্রোতারা। এই মিয়ারা তোমাগো পড়ালেহা কতদূর? কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়ছো?
শ্রোতার নিশ্চুপ, কারো মুখে কথা নেই,
তোমরা বেশি বুঝো, নাকি আমি বেশি বুঝি?
আপনি শিক্ষিত মানুষ আপনি বেশি বুঝেন,
তাইলে আমার কথা শেষ করতে দাও, কতা না হুইন্নাই কতা কও ক্যা?
রাগে গজ গজ করতে থাকেন চেয়ারম্যান, এইযে দেখো আমাগো দেশে সম্পদ নাই, খাদ্যের অভাব। আমাগো দেশে যদি মানুষ কম হইতো তাইলে কি সম্পদের অভাব হইতো? যা আছে তা দিয়াই আমরা আরাম করে থাকতে পারতাম, এখন মানুষ বেশি, চাহিদা বেশি।
একজন হাত তুলে চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে,
তুমি আবার কি কইবা?
চ্যারমান সাব, আমাগো দেশে মানুষ বেশি হওয়াতেতো আমাগো ভালোই অইছে। যেমন ধরেন, আল্লায় আমাগো দেশে সম্পদ দেয়নাই, কিন্তু মানুষ দিছে, আবার ধণী রাষ্ট্র গুলাতে সম্পদ দিছে কিন্তু মানুষ দেয়নাই।
এখন আমাদের দেশে যে অতিরিক্ত মানুষ আছে সেগুলারে যদি ট্রেনিং দিয়া ধণী রাষ্ট্রে পাঠাইয়া দেই, তাইলেতো তারা সেখানে গিয়া টাকা পয়সা কামাই কইরা দেশে পাঠাইতে পারে। এইডা আমাগো লাভ।
আবার দেখেন, পোশাক তৈরী এবং রপ্তানিতে আমাগো দেশ ফাস্ট অইছে, আমাগো দেশে মানুষ যদি বেশি না অইতো তাইলে কি এইডা সম্ভব অইতো?
তাছাড়া ধনী রাষ্ট্রগুলা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক উন্নত, আমরাও যদি শিক্ষাদিক্ষায় উন্নত অইতে পারি, তাইলেতো আমাগো দেশও ধনী অইয়া যাইবো। নতুন নতুন মেশিন আবিস্কার অইবো, মিলকারখানা অইবো, আমাগো দেশে অনেক মানুষ আছে, বিদেশ থিকা মানুষ আনা লাগবোনা, নিজেগো মানুষ দিয়াই বাংলাদেশ ধনী অইয়া যাইতে পারবো।
তোমার কতায় যুক্তি আছে, সম্মতি সূচক মাথা ঝুলায় সাদেক মৃধা। তা কতা কইলেইতো অইলোনা, ধণী রাষ্ট্রগুলার মতো আমাগো পোলাপানরে শিক্ষা দেয়ার মতো টাকা কি আমাগো আছে?
তাদের মতো টাকা নাই ঠিকই, তবে যা আছে হেইডাওতো চুরি অইয়া যাইতাছে। শুনলাম, কাগজে কলমে আমাগো স্কুল বিল্ডিং হওয়ার কতা আছিলো তিনতলা, এখন দেখি অইছে দুই তলা। আরেক তলার টাকা কই গেছে?
আবার হুনলাম, শিক্ষামন্ত্রী নাকি আমাগো দেশে সস্তায় বই না ছাপাইয়া, বেশি টাকা দিয়া ভারতে বই ছাপাইতে দিছে, কমিশন খাওয়ার লোভে। আর আমাগো দেশের প্রেস মালিকরা কাজ না পাইয়া প্রেস বন্ধ করে দিতাছে।
খুক খুক করে কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করলেন চেয়ারম্যান সাদেক মৃধা, হেইডা ভিন্ন প্রসঙ্গ! ওগুলা তোমরা বুঝবানা। তোমরা অইছো গিয়া কুয়ার ব্যাঙ, কুয়ার ব্যাঙ বুঝো? কুয়ার ব্যাঙ কুয়ারেই বিশ্ব মনে করে, দুনিয়ার আর কোনো কিছু তাদের বুঝাইলেও বুঝেনা। তোমাগো পড়ালেখা কম এগুলা তোমরা বুঝবানা।
সাদেক মৃধা দ্বিধায় পড়ে যায়, এই অশিক্ষিত মানুষগুলাকে কিভাবে বুঝাবে জনসংখ্যা সমস্যা হচ্ছে এদেশের প্রধান সমস্যা। বাড়তি জনসংখ্যা সমস্যার কারণেই এদেশ পিছিয়ে রয়েছে।
পানের কৌঠা ভর্তি খিলি পান থেকে চট করে একটা মুখে পুড়ে দেয় সাদেক মৃধা। নাহ! ছোট বউয়ের হাতে যাদু আছে, দারুন পান বানায়।পানতো নয় যেনো মধু!
আচ্ছা তোমাগো একটা উদাহরণ দেই, নড়ে চড়ে বসে শ্রোতারা, মনে মনে কথা গুছিয়ে নেন চেয়ারম্যান। এইযে হারিছ উদ্দিন তার পোলারে কোলে করে বসে আছে। এই পোলার বয়স কতো?
হারিছ মিয়া পরম মমতায় ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জবাব দেয়, ৫বছর চ্যারমান সাব, আল্লাহ দিলে ব্রেন অনেক ভালো।
তোমার পোলা মাইয়া কয়ডা?
আল্লায় দিলে ৬জন চ্যারমান সাব।
আচ্ছা তোমার মাসিক ইনকাম কতো?
দশ-বারো হাজার টাকার মতো রোজগার করি।মাথা নিচু করে জবাব দেয় হারিস মিয়া।
এই ইনকাম দিয়ে এতোবড় পরিবার চালাতে তোমার কষ্ট অয়না? নিজের যুক্তির দিকে আত্মবিশ্বাসী ভাবে এগিয়ে যান সাদেক মৃধা।
একটু কষ্ট অয়, তারপরেও আল্লার কাছে শুকরিয়া, আল্লায় ভালোই রাখছে।
ধরো তোমার পোলা-মাইয়া মাত্র দুইটা, তাইলে এই ইনকামে তোমার সংসার এরচাইতে ভালো চলতোনা?
ছেলেটিকে বুকে চপে ধরে মাথা নিচু করে থাকে হারিস মিয়া।
নিজের মনেই মৃদু হেসে ওঠে সাদেক মৃধা, বিজয়ের আভা চোখে মুখে। দেখলাতো মিয়ারা, জনসংখ্যা যে আমাদের একটা বিরাট সমস্যা হেইডা এইবার বিশ্বাস অইছে?
মৃদু স্বরে প্রতিবাদ করে ওঠে হারিস মিয়া, আমার পোলা-মাইয়াগুলা আল্লাহ দিছে, আবার আমার এই আয়ের টাকাও আল্লায় দিছে। আমার পোলা-মাইয়া যদি দুইডা অইতো তাইলে যে এরচাইতে কম ইনকাম অইতোনা হেইডা আমি কেমনে কমু? রিজিকের মালিক আল্লাহ!
ও এখন আল্লাহ’র কথা কও? আল্লায় কি তোমারে সাত-আটটা পোলা-মাইয়া নিতে কইছে? এখন এই পোলা-মাইয়া গুলানরে মানুষ করবা কেমনে? সবগুলাতো মূর্খ অইবো! তুমি ভুল করছো হেইডা স্বীকার করো।
না, মূর্খ অইবোনা, ওগোরে স্কুলে ভর্তি করছি, সবগুলা উচ্চশিক্ষিত অইবো, প্রতিবাদ জানায় হারিস মিয়া।
শুনছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি হের বাবা-মায়ের চৌদ্দ নম্বর পোলা। চিন্তা কইরা দেখেন, যদি হের বাবা-মা দুইটা সন্তান জন্মের পরেই আপনার এই বক্তব্য শুনতো তাইলে রবীন্দ্রনাথের জন্ম অইতো?
হারিসের কথা শুনে, উচ্চস্বরে হেসে ওঠে উপস্থিত শ্রোতারা। হারিছ মিয়া কতাডাতো মিছা কয়নাই চ্যারমান সাব।
থামো তোমরা! খেকিয়ে উঠেন সাদেক মৃধা। এতো হাইসোনা! কই আগরতলা, আর কই চোকীর তলা! তোমার পোলায় কি রবীন্দ্রনাথ অইবো নাকি?
উঠে দাড়ায় হারিস মিয়া, চ্যারমান সাব, বাড়িতে ম্যালা কাম পইরা আছে, এখন যাইতে অইবো।
যাওয়ার আগে একটা কতা কই, আপনারাতো ছয় ভাই, ভাইগো মইধ্যে আপনিই ছোড, আপনার মরহুম আব্বা হুনছি আপনাগো নিয়া অনেক পরিশ্রম করছে, অনেক কষ্টে আপনার ভাইগো মানুষ করছে।
মরহুম পিতার কথা মনে হতেই আবেগে চোখের পানি চলে আসলো চেয়ারম্যান সাদেক মৃধার। রুমালে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, তুই ঠিকই শুনেছিস, আমার আব্বার মতো মানুষই অয়না।
আচ্ছা চ্যারমান সাব, আপনিতো ছয় নম্বর পোলা, আপনার বাবায় কি আপনারে জন্ম দিয়া ভুল করছিলো?
জবাবের অপেক্ষা করেনা হারিস মিয়া। ছেলেকে কাঁধে চাপিয়ে বাড়ির দিকে হাটা দেয়। বিশাল কাঁধে চরে বাবার মাথার চুল নিয়ে খেলা করে হারিসের ছেলে।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাদেক মৃধা। অস্ফুট স্বরে মুখ হতে বেরিয়ে আসে, মূর্খ! মূর্খ!
২৬জানুয়ারী২০১৪
No comments:
Post a Comment