মিছিলে যাবো।

কে ওখানে?
শব্দটা আবার হলো ঠক ঠক, ঠক ঠক!
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো, এখন বাজে রাত ৩টা, এই অসময় ঘুমের বারোটা বাজানোর জন্য আবার কে এলো! শালার ব্যাচেলর লাইফের এই এক সমস্যা, রাতনেই দিননেই, নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা, আরে ব্যাটা আসবিতো দিনের বেলা আসলে সমস্যা কি, এই শীতের রাতে কি তোকে পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে!
আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, ঠক ঠক। ঠক ঠক
অনেক কস্টে হাচড়ে পাচড়ে কম্বলের নিচ হতে শরীরটা টেনে বের করে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দরজার কাছে পৌছলাম, তীব্র ঠান্ডায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
কপাট খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম, ‘হাসান তুই! এতো রাতে! কোনো সমস্যা হয়নিতো?!’
‘বলছি, আগে গায়ে কিছু একটা দে, ঠান্ডায় মরে যাচ্ছি’।
বিস্মিত ভাবটা কেটে যেতেই দেখলাম এই তীব্র শীতের রাতেও খালি পায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি এবং লুঙ্গি ছাড়া হাসানের গায়ে আর কিছু নেই।
আয় আয় ভেতরে আয়, দ্রুত হাতে রশিতে ঝোলানো জ্যাকেটটা হাসানের হাতে তুলে দিলাম। ছোট্ট ব্যাচেলর রুম আমার, একটা চকি, একপাশে একটা টেবিল এবং চেয়ার এটাই সম্বল। কাপড় রাখার মতো আলনা নেই, দেয়ালে পেরেক দিয়ে রশি টানিয়েই কাপড় রাখার ব্যবস্থা করেছি।
কোথায় বসতে দেই, একটা মাত্র চেয়ার, তার আবার পায়া ভাঙা, ‘নে বিছানাতেই বসে পর’।

হাসান আমার বাল্যবন্ধু, সেই প্রাইমারী হতে শুরু করে এখন ভার্সিটির লাইফ একসাথেই পড়ছি। বিত্তশালী-প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য এই হাসান, বাজারের সবচাইতে বিশাল দোকানের মালিক হাসানের পিতা, আট-দশটা বড় কোম্পানীর ডিলারশীপ আছে। আর সেই হাসান কিনা খালি পায়ে,খালি গায়ে আমার বাসায় ছুটে এসেছে, নিশ্চই বড় কোনো অঘটন ঘটেছে!
‘চা খাবি?’
‘না না এতো রাতে তোকে বিরক্ত করলাম, এখন কষ্ট করার প্রয়োজন নেই’।
‘আরে রাখ তোর কষ্ট! ফ্লাক্সে গরম পানি আছে, টিব্যাগ ভেজালেই হয়ে যাবে’। অভ্যাস্ত হাতে দুটো চা বানিয়ে ফেললাম, ‘নে চা খা! এই শীতের রাতে এক কাপ চা দারুণ জমবে!’
‘রাতে কিছু খেয়েছিস, নাকি না খেয়েই ঘুরছিস?’
‘খেয়েছিলাম’।
‘দেখ একদম সঙ্কোচ করবিনা, যদিও অধিকাংশ সময়ে হোটেলেই খাওয়া হয়, তবে একটা কেরোসীনের চুলা আছে, মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হলে ঘরেও রান্না করি। আজ আলু ভর্তা এবং ডিম ভাজি করেছিলাম, সাথে ডাল ছিলো হেব্বি খাওয়া হয়েছে। ডাল বোধহয় খানিকটা রয়ে গেছে, ঘরে ডিম আছে, খাবি কিনা বল’।
‘না না, তোর কাছে সঙ্কোচ কিসের, রাতে খেয়েই ঘুমিয়েছিলাম। তারপরতো এখানে’।
‘আচ্ছা এবার শুরু কর, কি হয়েছে, তোর এই অবস্থা কেনো?’

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে বসে রইলো হাসান, তারপরে ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলো।
‘তুইতো জানিস, আব্বা ব্যবসায়ী মানুষ। কখনো কোনো ঝুট ঝামেলায় জড়াতে চায়না, পাড়ার মাস্তানরা যখন যা চায় নির্দিধায় দিয়ে দেয়। ব্যবসা করতে হলে ওদের সাথে বিবাদ করা যাবেনা’।
‘হ্যা সেটা জানি, এলাকার জাফর মাস্তানের লোকজন মাঝে মধ্যেই তোদের দোকানে আসতো, আমার সামনেই চাচা বেশ কয়েকবার ওদেরকে বিভিন্ন উপলক্ষে চাঁদা দিয়েছে। চাচা হাসতে হাসতেই একদিন বলেছিলেন, বুঝলা ভাতিজা এরই নাম রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, দাও চাঁদা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিন দাও চাঁদা, বঙ্গবন্ধু পাকিস্থান হতে দেশে আসছে এই দিনে, দাও চাঁদা। স্বাধীনতা দিবস দাও চাঁদা, বিজয় দিবস দাও চাঁদা। ভাষা দিবস দাও চাঁদা। এই চাঁদা দিতে দিতে আমাদের ব্যবসা চাঁদের দেশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে’।
‘হ্যা, দিন দিন ওদের চাহিদার পরিমান বৃদ্ধি পেতে লাগলো, সাফ জানিয়ে দিলো, নিয়মিত টাকা দিতে না পারলে ব্যবসা করতে দিবেনা। নিরুপায় হয়ে আব্বাও সাধ্যমতো ওদের টাকা-পয়সা দিয়ে দিতো। সেদিন জাফর এসে জানালো এলাকায় যৌথ বাহিনী আসবে, লিস্টে আমাদের দুই ভাইয়ের নাম উঠেছে আমরা শিবির করি। এখন লিস্ট থেকে নাম কাটাতে হলে ৩লাখ টাকা দিতে হবে, নইলে ক্রস ফায়ারে আমাদের মৃত্যু হলে তার কিছু করার নাই’।
‘কি বলছিস এসব! তুই আবার শিবিরে জয়েন করলি কবে থেকে! আমিতো জানি তুই রাজনীতিকে দুই চোখে দেখতে পারিসনা’
‘তুই ঠিকই জানিস, আমরা দুই ভাইয়ের একভাইও শিবির করিনা, তাছাড়া রাজনীতি যদি করতেই হয়, দেশে অনেক দল আছে ওই রাজাকারদের দল কেনো করতে যাবো!’
‘তারপর কি হলো?’
‘চায়েরকাপে চুমুক দিয়ে আবার কথা শুরু করলো হাসান, আব্বা সাফ জানিয়ে দিলো এতো টাকা দিতে পারবেনা। ওই রাতেই যুবলীগের মিছিল হতে আমাদের দোকানে আগুন লাগানো হলো’।
‘কি বলছিস এসব!’ হাসানের কথা শুনে আতকে উঠলাম। ‘আমিতো শুনেছি বাজাড়ে জামায়াত-শিবির আগুন দিয়েছে’।
‘হ্যা, মিডিয়াতে তেমনই এসেছে, আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম, মিডিয়া সেটা ছাপেনাই। আব্বা থানায় গিয়েছিলেন জাফর মাস্তানের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য, থানা মামলা নেয়নাই’।
‘আজব! মামলা নিবেনা কেনো? দোকানে আগুন লেগেছে মামলা নিতে সমস্যা কোথায়?’
‘সমস্যা অন্যখানে, থানা থেকে বলা হয়েছে এমপি সাহেব ফোন করেছিলেন, আগুন লাগানোর ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলা হয়েছে। যদি আমরা রাজি হই তবে এমপি-সাহেব নিজে দোকান পরিদর্শনে আসবেন এবং কিছু ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা করবেন, টিভি ক্যামেড়া আসবে, পত্রিকায় আসবে। মিথ্যা মামলা করতে আব্বা রাজী হননাই’।
‘অদ্ভুত এদেশ! নোংরা রাজনৈতিক খেলার বলি আমরা সাধারণ জনগণ, তারপর কি হলো?’
‘বলছি, তোর ঘরে পানি হবে? পায়ে কাদা লেগে আছে একটু ধুয়ে আসি’।
‘ওইতো বালতিতে পানি আছে, যা ধুয়ে আয়, কাদা লাগলো কিভাবে?’

আবার কথা শুরু করলো হাসান, ‘বাড়িতে এসেই শুনতে পেলাম আমাদের দুই ভাই এবং আব্বার নামে মামলা হয়েছে’
‘তোদের নাম আবার কি মামলা’?
‘ঘোশের পাড়ার কালি মন্দির ভাঙচুরের মামলা’
‘মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো! আরে কালি মন্দিরতো জাফর মাস্তান এবং তার দলবল ভাঙচুর করেছে মন্দিরের জমি দখল করার জন্য, এটাতো এলাকার সবাই জানে! এই মামলায় তোদেরকে জড়ানো হইছে কেনো?’
‘দোকানে আগুন দেয়ার ঘটনায় আমরা জাফরের বিরুদ্ধে মামলা করতে থানায় গিয়েছিলাম, সেকারণে এমপি’র সহযোগীতায় জাফর এই মামলায় আমাদের জড়িয়েছে। মন্দিরের পুরোহীত হারান কাকার সাথে আমি কথা বলেছিলাম, তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বাবা সবইতো বুঝ! আমরা গরীব মানুষ, নিজেদের জান বাঁচাইতে অনেক কিছু করা লাগে, তোমরা আমাদের মাফ করে দিও”।
পরেতো এলাকায় হুলস্থুল বেধে গেছে, ঢাকা থেকে সাংবাদিক এসেছে, টিভি ক্যামেড়া এসেছে, স্থানীয় গণজাগরণমঞ্চ দেখলাম মন্দির ভাঙার দায়ে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী জামায়াত শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেছে। আর সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেছে জাফর মাস্তান, তার একপাশে দাড়িয়ে ছিলো মন্দির কমিটির সভাপতি হারাধন চাচা আর অন্যপাশে মন্দিরের পুরোহীত হারান কাকা। ঘোশের পাড়ার হিন্দুরা জামায়াত-শিবিরের বিচার দাবী করেছে। আর এমপি সাহেব শুনলাম মন্দির পূণনির্মানের আশ্বাস দিয়েছেন এবং হিন্দুদের মধ্যে ত্রান বিতরণ করেছেন’।
‘হায়রে রাজনীতি! বহুত খারাপ হয়ে গেছে। এই রাজনীতি! তোর গল্প শুনেতো মাথা ভন ভন করতেছে, তারপর কি হলো বল’
‘বলছি, ফ্লাক্সে গরম পানি আছে কিনা দেখতো, আরেক কাপ চা খাবো’
পানি তখনো পর্যাপ্ত গরম ছিলো, ঝটপট দু’কাপ চা বানিয়ে ফেললাম।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হাসান আবার শুরু করলো। ‘মন্দির ভাঙার মামলার কারণে জাফর মাস্তানের নেতৃত্বে যৌথবাহিনী বেশ কয়েকবার আমাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে, আমরা প্রতিবারই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছি’ আজ রাতে আর সেটা সম্ভব হয়নাই’।
মানে! হাসানের কথা শুনে চমকে উঠলাম। ‘চাচা কই, হোসেন ভাই কই? চাচী, বড় আপা? তারা সবাই এখন কোথায়?’
বিষণ্ণ হয়ে গেলো হাসানার কন্ঠ ‘আম্মা আর বড় আপাকে দুই-দিন আগে নানু বাড়ি দিয়ে এসেছি। আব্বা আর বড় ভাইয়াকে যৌথবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে, আমি ঝোপের পাশে লুকিয়ে ছিলাম, আমার চোখের সামনেই সেকি নির্যাতন! ছলছল করে উঠলো হাসানার চোখ, দূর থেকে দেখলাম বুলডোজার দিয়ে বাড়িটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে!’
কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো হাসান, কি বলে শান্তনা দিবো বুঝতে পারছিলামনা। আসলে শান্তনা দেয়ার মতো ভাষাও অবশিষ্ট নেই। মাথায় একটা হাত রেখে বললাম কান্না করে কি হবে, এখন কি করা যায় সেটাই ভাবতে হবে। চাচা আর বড় ভাইয়াকে কিভাবে ছাড়িয়ে আনা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।

কথা শেষ হতে হতে ফজরের আজান দিয়ে দিলো, এমনিতে তেমন একটা নামাজ পড়া হয়না। কিন্তু আজ কেনো যেনো খুব করে নামাজ পড়তে ইচ্ছে হলো, এমনিতেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে, মনে হলে নামাজ পড়লে প্রশান্তি অর্জন করা যাবে।
‘চল হাসান নামাজ পড়ে আসি’
হাসানও উঠে দাড়ালো, চল!

কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর, নামাজ শেষ, মসজিদ চত্ত্বরের এখানে সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জটলা, দুই একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি ব্যাপার এতো মানুষ কেনো?’
কেউ কোনো কথা বলছেনা, অধিকাংশই ইয়াং বয়সী ছেলে-পেলে।
হাসান জিজ্ঞাসা করলো, ‘এতো তরুন মুসল্লী এরা কারা, এখানেতো মাদ্রাসা দেখছিনা’।
চিন্তিত ভঙ্গিতে বললাম, ‘জানিনা, এরা মাদ্রাসা ছাত্র নয়, তবে মনে হচ্ছে শিবিরের মিছিল হবে, এতো ইয়াং ছেলে পেলে এই মসজিদে একসাথে নামাজ পড়েনা, বিভিন্ন এলাকা থেকে জড়ো হয়েছে মিছিলের কারণে। আর যদি আমার ধারণা ঠিক হয় তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই এখানে কেয়ামত শুরু হয়ে যাবে, দ্রুত পালাতে হবে’।
‘কেয়ামত শুরু হবে মানে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলো হাসান।
‘শিবিরের মিছিলে স্লোগান দিতে দেরী হয়, পুলিশের গুলি করতে দেরী হয়না। যেখানে শিবিরের মিছিল সেখানেই পুলিশের গুলি,টিয়ারশেল,সাউন্ড গ্রেনেড থাকবেই। দ্রত এখান থেকে কেটে পড়তে হবে, চল বাসায় যাই’
‘না, আমি যাবোনা, তুই বাসায় যা’। হাসানের কন্ঠে দৃঢ়তা।
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি বলছিস তুই?
‘হ্যা, তুই যা, আমি মিছিলে যাবো’।
তুই পাগল হয়েছিস! এটা রাজাকার শিবিরের মিছিল।
হ্যা, আমি শিবিরের মিছিলেই যাবো, হাসানের কন্ঠে প্রত্যয়।
ততক্ষণে মিছিল শুরু হয়ে গেছে, হাজার হাজার কন্ঠে একসাথে স্লোগান,
নারায়ে তাকবীর,
আল্লাহু আকবর!
মিছিলের সাথে মিশে গেলো হাসান, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মিছিলের সামনের দিকে, ঠিক সেদিকটায় যেদিকে তাক করা আছে পুলিশের বন্দুকের নল!
আমি এখান থেকেও হাসানের কন্ঠে শুনতে পাচ্ছি,
নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর।
বিপ্লব বিপ্লব, ইসলামী বিপ্লব।
শিবিরের বিপ্লব, ইসলামী বিপ্লব।
শিবির দিচ্ছে আলোর ডাক, ছাত্রসমাজ জাগরে জাগ।

১৩জানুয়ারী২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment