“জামায়াত শিবির নিপাত যাক, সুমিতা মুক্তিপাক!”

ধানমন্ডির একটি পাঁচতলা বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর। এটাই বঙ্গদেশের ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উজ্বল আলোয় আলোকিত হলরুম, বিশাল ডেস্কের চারপাশে গোল হয়ে বসেছেন আগত অতিথিরা। হলরুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা, ভারতের অর্থে পরিচালিত বঙ্গদেশের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে মি.কাও এর বক্তব্য শোনার জন্য। বিরানী জাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ডাঃ কামরান কিছু একটা বলার জন্য হাত উচু করলো, তাকে থামিয়ে দিলেন মি.কাও। পাশেই কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে বসে আছেন বঙ্গদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য সংঘের সভাপতি হরিদাস পাল।
গম গম করে উঠলো কাওয়ের কন্ঠ, আপনি যাই বলেন আজরফ সাহেব, জামায়াত-শিবিরের জনপ্রিয়তা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা কিন্তু আমাদের বিরাট ব্যার্থতা।
নড়েচড়ে বসলেন সৈয়দ আজরফ, এই একটি মাত্র লোকের সামনে তিনি কুকড়ে যান। অসীম ক্ষমতার মালিক মি.কাও। তার আঙুলের ইশারায় যেকেউ উঠে যেতে পারে ক্ষমতার শীর্ষে, আবার হতে পারে ধপাস পতন।

আমরাতো চেস্টার ত্রুটি করিনাই, আপনাদের ইচ্ছেমাফিক সবকিছুই করেছি। সাজানো ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের ফাঁসির ব্যবস্থা করেছি, গ্রেপ্তার করেছি লক্ষ লক্ষ জামায়াত-শিবির কর্মীকে, দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল হতে শুরু করে সবগুলো দলীয় কার্য্যালয় বন্ধ করে দিয়েছি। মিছিলে গুলি করে হত্যা করেছি শত শত জামায়াত-শিবির কর্মীকে। আমাদের আর কি করার ছিলো, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিলেন সৈয়দ আজরফ।

আমি কিছু বলতে চাই, হাত উচিয়ে মাইক চাইলেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য সঙ্ঘের সভাপতি হরিদাস পাল। সবগুলো মুখ তার দিকে ঘুরে গেলো। মাথা ঝুকিয়ে সম্মতি দিলেন মি.কাও।
আমরা জঙ্গী ইস্যুকে কাজে লাগাতে ব্যার্থ হচ্ছি কেনো, দেখা যাচ্ছে আমেরিকা সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ জামায়াতকে জঙ্গীবাদী সংগঠন মনে করেনা, তাহলে আমাদের টাকায় লালিত-পালিত মিডিয়া কি করছে? তারা কি বসে বসে আঙুল চুষে! একটা ইসলামী দলকে জঙ্গী প্রমান করা কি কঠিন কিছু? রাগান্বিত কন্ঠেই কথাগুলো বললেন হরিদাস পাল।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মতিলালের দিকে জিজ্ঞাসু দৃস্টিতে তাকালেন কাও। মতিলাল বাংলাদেশের সবচাইতে প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদক। কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে কথা শুরু করলেন মতিলাল। দেখুন হরিদাস সাহেব যেটা বললেন, আমরা কিন্তু চেস্টার ত্রুটি করছিনা। জামায়াত-শিবিরের হাতে লাঠি দেখলে সেটার বিশাল ছবি পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করি, এবং ‘র’ এর কমান্ডোরা যেসব অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে আমরা প্রায় সবগুলো ঘটনার জন্যই জামায়াত-শিবিরকে অভিযুক্ত করার চেস্টা করেছি। এমনকি পুলিশের গুলিতে শিবির কর্মী নিহত হলেও আমরা ‘জামায়াত-শিবিরের তান্ডব’ শিরোনাম করি।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে আমেরিকা সহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোতো অন্ধ নয়। সরকার জামায়াত-শিবিরের উপর এতো দমন নিপীড়ন পরিচালিত করার পরেও আমরা এখন পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারলামনা। পত্রিকা বলেন টিভি মিডিয়া বলেন কোথাও একটা ছবি,ভিডিও প্রকাশ করতে পারলামনা যেখানে শিবিরের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। তাহলে তারা কোন যুক্তিতে জামায়াতকে জঙ্গী সংগঠন বলবে?

মুফতি মাসুদের দিকে আঙুল তুললেন মি.কাও। আমাদের এই ব্যার্থতার কারণ কি, আমরা কেনো জামায়াত-শিবিরের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারিনাই? এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
বঙ্গদেশের সবচাইতে বড় জঙ্গি সংগঠন “জমিয়তে আনসার উল্লাহ”র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান এই মুফতি মাসুদ। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠেই তিনি শুরু করলেন, জামায়াত-শিবিরের হাতে অস্ত্রতুলে দেয়াকে আমরা যতটা সহজ মনে করেছি কাজটা আসলে ততটাই কঠিন। ওরা শিক্ষিত এবং বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস অধ্যায়ন করে ওরা এসব ব্যাপারে খুব বেশি সচেতন।
সরকারের অব্যাহত দমন পীড়ন এবং পুলিশ বাহিনীর গুলি করার ঘটনার সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আমরা শিবিরকে প্রথমে স্বল্পমূল্যে এবং পরবর্তীতে বিনামূল্যে অস্ত্র সরবরাহ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা রাজী হয়নাই। তবে আমরা পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছি কথাটা ভুল, আমরা এখনো চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রুট লেভেলের কর্মীদের মধ্যে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি তাদের চাপেই জামায়াত-শিবির সশস্ত্র সংঘাতের দিকে পরিচালিত হবে।
আমরা যদি সফল হই তবে জামায়াত-শিবিরকে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়া সহজ হবে এবং জঙ্গিবাদের অজুহাতে পুরো বিশ্বহতে বিচ্ছিন্ন করে ওদের ধ্বংশ করতে সক্ষম হবো বলেই আশা করছি।

কামরান কিছু বলতে চাও? জিজ্ঞাসু দৃস্টিতে কামরানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন কাও।
না, আমি আর কি বলবো। আমাদের পরবর্তী কর্মসূচী কি হবে সে ব্যাপারে ইন্সট্রাকশন চাচ্ছিলাম। তাছাড়া আমরা আগেরমতো অর্থনৈতিক সাপোর্ট পাচ্ছিনা, টাকা ছাড়াতো আন্দোলন জমানো যাবেনা। মিছিলে লোক আনতে হলে প্রচুর টাকা প্রয়োজন হয়।
টাকা পেয়ে যাবে, আর কোনো বিষয়?
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমার নিরাপত্তার কি হবে, দেশের যা অবস্থা এই সরকার যদি সারভাইভ করতে পারে তবে ভালো। কিন্তু যদি আমরা পরাজিত হই! আবেগে কন্ঠ বুজে এলো কামরানের।
ওটা নিয়ে ভেবোনা, সেই চিন্তা আমাদের হাতে ছেড়ে দাও।

ঝেড়ে কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করলেন মি. কাও, একে একে সবার মুখের দিকে একবার করে দৃস্টিপাত করলেন। তটস্থ হয়ে বসলো আগত অতিথিরা। টান টান উত্তেজনা সবার মধ্যেই, নতুন কি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ভারত সেটা জানার আগ্রহে কিছুটে ঝুকে বসলো আগত অতিথিরা।
বক্তব্য শুরু করলেন মি.কাও, সম্মানিত অতিথিরা জীবনের চরমতম ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আপনারা যেভাবে নিষ্ঠার সাথে ভারত সরকার প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন ভারত সেই বন্ধুত্বের উত্তম প্রতিদান প্রদান করবে। আপনারা অবগত আছেন ইতোপূর্বে আমাদের বেশ কয়েকটি প্রকল্প ব্যার্থ হয়েছে, কিন্তু আমরা হতাশ নই। আমরা নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোবো। এই পরিকল্পনা সম্পর্কে এইমূহুর্তে আমি বিস্তারিত কিছু বলছিনা, তবে সবার সামনে একটা করে খাম রয়েছে সেখানেই আপনাদের করনীয় কি সে ব্যাপারে ইন্সট্রাকশন দেয়া আছে, সভা আজকের মতো সমাপ্ত। সবাইকে ধন্যবাদ।

কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়লেন মতিলাল, ফিচার সম্পাদকদের ডেকে জামায়াত-শিবিরের হাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মর্মস্পর্ষী গল্প রচনার নির্দেশ দিলেন, আগামী চার-পাচ দিনের মধ্যেই এই গল্পগুলো পত্রিকায় আসবে। ফিচার সম্পাদকরা কিছুটা অবাক হলেও বিনা বাক্যব্যায়ে নির্দেশ মেনে নিলো, তাদের জানা আছে মতিলাল অনর্থক কিছু বলেননা। এর পেছনে নিশ্চই কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।

বিরানী জাগরণ মঞ্চের জরুরী সভা আহ্বান করেছেন ডাঃ কামরান। জামায়াত-শিবিরের হাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে শত শত ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করার পরিকল্পনা করা হলো। সভার একদম পেছনের দিক হতে একজন প্রশ্ন করলো, আচ্ছা কামরান ভাই দেশের কোথাওতো মন্দির ভাঙা হয়নাই, তাহলে ব্যানার ফেস্টুন কেনো? কামরানের মুখে রহস্যময় হাসি, ভাঙেনাই ভাঙতে কতক্ষণ!

হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য সংঘও বসে নেই। হরিদাস পালের নেতৃত্বে সভা হলো। জাতীয় বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষতি মেনে নেয়ার আহ্বান জানানো হলো উপস্থিত হিন্দু ধর্মীয়ে নেতাদের কাছে। ধর্মীয় নেতাদের অনেকেই বিস্তারিত জানতে চাইলেন, কেউ কেউ ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্ন করলো কি ধরনের ক্ষতি? আর ক্ষতির প্রশ্নইবা আসছে কেনো?
বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করলেন হরিদাস পাল, সবাইকে জানিয়ে দিলেন ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাই কিছু ঘটুক ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

হাম্বালীগ মহাসচিব সৈয়দ আজরফ তার টিম নিয়ে প্রস্তুত, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের জন্য গঠন করা হলো আলাদা আলাদা টিম।

কেয়ামত শুরু হয়ে গেলো বঙ্গদেশে, দাউ দাউ করে জ্বলছে মন্দির, জ্বলছে হিন্দুপাড়া, জ্বলছে মানবতা। দীর্ঘদিন ধরেই পাড়ার নামকরা মাস্তান সজিবের কু-দৃস্টি হরিদাস পালের একমাত্র মেয়ে সুমিতার দিকে। কেন্দ্র হতে গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে আর দেরী করলোনা সজিব। সহযোগীরা বারবার নিষেধ করে বললো হরিদাস পালের বাড়ির ধারে কাছেও যাওয়া নিষেধ আছে, কে শোনে কার কথা, আমি হরিদাস-বড়িদাস চিনিনা, এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবেনা। অপহৃত হলো হরিদাসের মেয়ে সুমিতা।

দেশব্যাপী হিন্দু এলাকায় আগ্নিসংযোগ,লুটপাট এবং সুমিতা অপহরণের জন্য জামায়াত-শিবির’কে দায়ী করে রিপোর্ট প্রকাশ করা হলো মতিলালের পত্রিকায়। বিক্ষোভ মিছিলে ফেটে পড়লো বিড়ানী জাগরণ মঞ্চ। হিন্দু,বৌদ্ধ,খৃস্টান ঐক্য সংঘের মিছিল পরবর্তী সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে সাম্প্রদায়ীক জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবী জানালেন। বঙ্গদেশের হিন্দুদের রক্ষার জন্য ভারতের রাজনৈতিক দল সমূহের পক্ষ হতে বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের দাবী উত্থাপন করা হলো।

আর্তনাদ করে উঠলো হরিদাস, সুমিতার সন্ধানে ছুটে গেলো আজরফের কাছে। ছুটে গেলো মি.কাও এর কাছে, সুমিতার সন্ধান কারো কাছেই নেই। হরিদাস এখন মিডিয়ার অফিসে অফিসে ঘুরে, সাক্ষাৎকার প্রদান করে, “জামায়াত-শিবির নয়, আমার মেয়েকে অপহরণ করেছে হাম্বালীগের সন্ত্রাসীরা! মন্দিরে, হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে হাম্বালীগের সন্ত্রাসীরা”।

পরের দিন মতিলালের পত্রিকায় বিশাল হেডিং-এ নিউজ হয়, “জামায়াত শিবির নিপাত যাক, সুমিতা মুক্তিপাক!”


১০জানুয়ারী২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment