মৃণালের রাণী

মৃণাল সাহেব আর বসে থাকতে পারলেননা, উঠে ঘরময় পায়চারী শুরু করলেন। বিশাল রিডিং রুম, থরে থরে সাজানো দেশী বিদেশী নানান লেখকের বইয়ে ঠাসা পুরো ঘর। দেয়ালের একপাশ জুড়ে ঝুলছে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ পোট্রেট।
রিডিং রুমের মাঝখানটায় সেই বিশাল সেগুনকাঠের টেবিলটা আগেরমতই আছে, চেয়ারগুলো ছড়ানো ছিটানো এখানে সেখানে। বদলায়নাই কোনো কিছুই, রুমের এখানে সেখানে বেশ কিছু সংস্কার কাজ করা হয়েছে, রিডিংরুমে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু বই, পার্থক্য এটাই।

রাণীকে দেখে ভূতের দেখার মতোই চমকে উঠলেন মৃণাল সাহেব, তুমি কখন এলে?
এইতো এইমাত্র! তোমার কি খবর, কেমন আছো? রাণীর শীতল কন্ঠ।
‘আমার খবর আর কে রাখে! আছি, ভালোই আছি’।
‘হেয়ালী করোনা, হেয়ালী আমার ভালো লাগেনা, আমিতো তোমাকে চলে যেতে বলিনাই, তুমিইতো......’
থাক, সেই স্মৃতি মনে করে আর দুঃখ বাড়াতে চাইনা, কথার মাঝখানে রাণীকে থামিয়ে দেয় মৃণাল। তোমার বাড়ির গেট থেকে এই রুম পর্যন্ত আসতে আমার দুই ঘন্টা সময় লেগেছে, এমনতো হওয়ার কথা ছিলোনা!
‘অনেক কিছুইতো হওয়ার কথা ছিলোনা, তারপরেও হয়েছে। ওরা তোমাকে চিনতে পারেনাই তাই এমনটি হয়েছে। আমি ওদেরকে বলে দিবো ভবিষ্যতে যেনো এমন না হয়। সে যাই হোক, আমার হাতে সময় কম, জরুরী কাজ পরে আছে, তোমাকে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবোনা। দ্রুত কথা শেষ করতে হবে’।
আমাকে বসতে বলবেনা? নাকি রাণীর বাড়ি হতে এভাবেই বিদায় নিবো, মৃণালের কন্ঠে তাচ্ছিল্য ঝড়ে পড়ে।

একপাশে বিশাল সেগুন কাঠের টেবিল, মুখো মুখি দুটি চেয়ারে বসে আছে রাণী আর মৃণাল। সময় যেনো থমকে গেলো, স্মৃতির রাজ্যে হারিয়ে গেলো দুটি মানুষ। কত কত স্মৃতি এই রুমটি ঘিরে। কিছুই বদলায়নাই, মানুষ গুলো বদলে গেছে, মৃণালের বয়সটাকি একটু বেড়েছে? কিংবা রাণীর মসৃণ চামড়ায় কি পড়েছে বয়সের ছাপ!
হ্যা দিন বসে নেই, দিন যায় রাত আসে, মানুষ পরিবর্তন হয়, মানুষের রুচির পরিবর্তন হয় এবং মৃণালের রাণী হয়ে যায় আপামর জনসাধারণের রাণী, দেশের রাণী।

রাণীই নিরবতা ভাঙে, এভাবে কি ভাবছো?
না কিছুইনা, ভাবছি মানুষ কেমন পাল্টে যায়। মৃণালের কন্ঠে দীর্ঘশ্বাস।
‘দেখো মৃণাল, তখন আমার কিছুই করার ছিলোনা, আমি যদি সাধারণ কোনো পরিবারের মেয়ে হতাম! আমি চাইলেই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা, আমার পারিবারিক ঐতিহ্য আছে, আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের প্রশ্ন জড়িত ছিলো। আমার স্বামী ছিলো, সংসার ছিলো, তুমিতো কিছুই বুঝতে চাইলেনা, রাগ করে চলে গেলে’।
মৃণাল সাহেব চুপ হয়ে রইলেন, নিশ্চুপ দৃষ্টিতে কাচের আলমাড়িতে রাখা বইগুলো গুনছেন।
তোমাকে আমি কতবার বলবো, মৃণাল! রাণীর কন্ঠে আকুতি ঝড়ে পড়ে।
‘আমিতো অস্বীকার করছিনা, আমি তোমার সমস্যাগুলো বুঝেইতো চলে গিয়েছিলাম’।
‘তারপরেও তুমি চাইলে কিন্তু থেকে যেতে পারতে’।
বাদ দাও ওসব। এই বিষয়ে কথা বলতে আর ভালো লাগছেনা।

টেবিলের এক কোনে পড়ে থাকা কোরআন শরীফটার দিকে চোখ পড়তেই তীর্যক হাসি ফুটে ওঠে মৃণালের ঠোটে। ওটা এখানে কেনো? ইদানিং ধর্ম চর্চা ভালোই চলছে মনে হয়!
তুমিতো সবই বুঝো! ফটো সেশনের জন্য মাঝে মধ্যে প্রয়োজন হয়, কন্ঠের বিব্রত ভাবটা লুকোতে পারেনা রাণী।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে মৃণাল, হাসির দমকে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
বিরক্তিতে ভ্রু কুঞ্চিত হয় রাণীর, এভাবে হাসার মানে কি?
মজা পাচ্ছি! দেশের সব চাইতে ক্ষমতাশালী নারীকে দেখছি! যার আঙুলী হেলনে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়, প্রতিপক্ষ দলের বিশাল বিশাল ইসলামীক নেতাকে। সেই নারীর এমন অসহায় অবস্থা দেখে সত্যিই আমি মজা পাচ্ছি! হাসতে হাসতেই জবাব দেয় মৃণাল।

‘আচ্ছা! এবার হাসি থামাও, এতোদিন পরে কি মনে করে এখানে এলে সেটা বলো, কিছুক্ষণ পরেই র(RAW) এর বাংলাদেশ শাখার অপারেশন চীফের সাথে একটা জরুরী মিটিং আছে। তোমাকে আর বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবোনা, দ্রুত কথা শেষ করতে হবে’।
ঠিক আছে আমি তবে উঠি, মৃণাল উঠে যেতে চায়।
‘বসো, কথা শেষ করো, রাণীর কন্ঠে অনুনয়’।
‘তোমারতো মিটিং আছে, মিটিং-এ যাও, আমি আরেকদিন আসি’।
‘না এখনই বলো, আরেকদিন আসলে আসা যাবে, প্রব্লেম নেই’।

কিছুক্ষণ ঝিম দিয়ে বসে থাকে মৃনাল, ধীরে ধীরে কথা শুরু করে। ‘আমি আসলে কয়েকটা বিষয়ে তোমাকে সতর্ক করতে এসেছি। তুমি আবার ভেবে বসোনা পুরনো সম্পর্কের কারণেই আমি কথাগুলো বলছি। কিন্তু তোমার একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে কথাগুলো বলা প্রয়োজন’।
‘এতো ভনিতা করার প্রয়োজন নেই, তুমি অকপটেই যা খুশি বলতে পারো’।
‘আমি বেশ কয়েকটি বিষয়ে পাবলিক ওপিনিয়ন তোমাকে বলতে চাই,’
‘আচ্ছা, এতোক্ষণ খালি মুখে কথা বলছি, কি খাবে বলো?’
‘না কিছু খাবোনা, ক্ষুধা নেই’।
‘ক্ষুধা নেই বললেই হলো, প্রচন্ড গরম পড়েছে, এক গ্লাস জুস অন্তত’।
কলিং বেল চাপ পড়তেই একটি মেয়ে এসে হাজারি, রাণীর ব্যক্তিগত কর্মচারী! দু গ্লাস জুসের অর্ডার দিয়ে তাকে বিদায় দিলো রাণী।

হ্যা, মৃণাল তোমার কথা শুরু করো। জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললেন রানী।
আমি কথা দীর্ঘায়িত করবোনা। দেখো তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে, মানুষ তোমার উপর ক্ষুব্ধ, একই ঘটনা ঘটেছিলো তোমার পিতার ক্ষেত্রেও, ফারাক্কা বাঁধের জন্য এদেশের জনগণ তোমার পিতাকে কখনো ক্ষমা করবেনা। টিপাই মুখে বাধ দেয়া হচ্ছে, তোমার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ নেই, তোমার লোকেরা এটাকে সমর্থন জানাচ্ছে। এদেশতো শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাবে! ট্রানজিটের নামে ভারতের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছো বাংলাদেশের নৌ ও সড়কপথ।
কিছুক্ষণ থেমে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলো মৃণাল, এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে।
‘তোমার কথা শেষ হয়েছে? আমি উঠবো’ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাণী।
‘আমি জানতাম, কথাগুলো তোমার ভালো লাগবেনা, তারপরেও আমাকে বলতে দাও, আমার কথা শেষ করতে হবে!’ চিৎকার করে ওঠে মৃনাল।
‘আচ্ছা, দ্রুত শেষ করো, আমার হাতে আর ছয় মিনিট সময় আছে’।
‘তোমার সহায়তায় বিডিআর ধ্বংশ করে দিলো ভারত, বাংলাদেশের আনাচা কানাচে এমনকি সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে পর্যন্ত RAW-এর অফিস। র’এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে যাকে তাকে ধরে গুম করে দিচ্ছো! সাতক্ষীরাতে ধ্বংশযজ্ঞ চালালো ভারতীয় সেনারা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কিন্তু চুপ করে থাকবেনা, সুযোগ পেলে ওরা ছেড়ে কথা বলবেনা’।
তোমার কথা শেষ হয়েছে, নাকি আরও কিছু বলবে? রাণীর কন্ঠে তাচ্ছিল্য।
‘দেখো এদেশের জনগণ কিন্তু বিষয়টা ভালো চোখে দেখছেনা। ভারতীয় নেতারা এদেশের ভূমি দখল করতে প্রকাশ্য ঘোশণা দিচ্ছে, অথচ তুমি বা তোমার দলের কেউ এর প্রতিবাদ জানাচ্ছনা। তুমিতো ধ্বংশ হয়ে যাবে!’ মৃণালের কন্ঠে আর্তনাদ।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন রানী, হাসির দমকে টেবিলের উপর গড়িয়ে পড়ছেন। কিছুটা ধাতস্ত হয়েই কথা শুরু করলেন রাণী। ‘দেখো মৃণাল, তুমি সুপুরুষ সেটা আমি অস্বীকার করবোনা। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, সুপুরুষ হলেই ভালো রাজনীতিবীদ হওয়া যায়না। রাজনীতিটা তোমাকে আমার কাছ থেকেই শিখতে হবে’।
হতবিহ্বল মৃণালের অবাক দৃষ্টি ভালোই উপভোগ করছেন রাণী।
‘দেখো মৃণাল, একটা সময় ফারাক্কা বাঁধ ছিলোনা, আমার বাবার লাভ কি হয়েছিলো? বলতে পারো, ফারাক্কা’র মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যই আমার পিতার উত্থান ঘটেছিলো।
তোমাকে আরো অনেক কিছুই জানতে হবে মৃণাল।
একটা সময়, বাংলাদেশে শক্তিশালী বিডিআর ছিলো, সীমান্তে ছিলো বাংলাদেশের একাধিপত্য। একটা সময় পদ্মা-মেঘনা-তিস্তায় ছিলো উন্মত্ত স্রোত। অথবা বলতে পারো একটা সময় বাংলাদেশ ছিলো ভারতের যেকোনো প্রকার আধিপত্যবাদের বাহিরে।
তুমি কি আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে, এতে আমার লাভ হয়েছে কি? আমি কি তখন এদেশে শাসন করতে পেরেছিলাম?’
মৃণাল কথা বলেনা, কথা বলার ভাষা মৃণাল হারিয়ে ফেলেছে।
রাণী আবার কথা শুরু করলেন, ‘দেখো মৃণাল, তুমি যেসব সমস্যাগুলোর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছো, সেসব সমস্যা সৃষ্টি করার জন্যই আমাকে এদেশের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে।
ধরো বাংলাদেশ খাদ্যে স্বংসম্পূর্ণ হয়ে গেলো, শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী তৈরী হলো, পদ্মা-মেঘনা-তিস্তায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ সৃষ্টি হলো, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এদেশ ছেড়ে চলে গেলো, কিন্তু আমি প্রধানমন্ত্রী হতে পারলামনা, তাহলে আমার লাভ কি?
তুমি কি অংক ভুলে গেছো? যাও বাসায় গিয়ে অংক চর্চা করো’।

RAW-কর্মকর্তাদের আসার সময় হয়ে গেছে, রাণী উঠে চলে যাচ্ছিলেন, পেছন হতে মৃণালের কন্ঠ শুনে ঘুড়ে দাড়ালেন।
‘রাণী, পাকিস্থান ভেঙে গেছে, ফারাক্কায় বাঁধ আজো আছে, তোমার বাবা আজ কোথায়?’

পিনপতন নিরবতা ঘর জুড়ে, মৃণালের প্রশ্নের জবাব রাণীর কাছে নেই, এ প্রশ্নের জবাব রাণী জানতেও চায়না। রাণী একটা কথাই জানে, ক্ষমতায় থাকতে হলে প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে।

গল্পঃ মৃণালের রাণী
© শামীম রেজা
২১/০৪/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment