সাংবিধানিক খুন

রমেশ!
আজ্ঞে রাণীমা!
‘যেভাবেই হোক দেশে বাহাত্তরের সংবিধান পূণস্থাপন করতে হবে, তুমি দলের সকল নেতাকর্মীকে এব্যাপারে নির্দেশনা জাড়ি করে দাও। আর একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করো, মনে রেখো বাহাত্তরের সংবিধানের একটি ধারাও বাদ দেয়া যাবেনা’।
‘জো হুকুম মহারাণী’
হাত কচলাতে কচলাতে রমেশ ছুটে যায় ভারতীয় হাই কমিশন অফিসে, বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হলে বিশেষজ্ঞদের নামের তালিকা সংগ্রহ করতে হবে। এতো বড় একটা কাজ ভারতের পরামর্শ ছাড়া করা ঠিক হবেনা।

বিশাল হলরুম, আলিশান গদিতে বসে আছেন মহারাণী। দরবারে উপস্থিত ভারত সরকারের অতি আস্থাভাজন বুদ্ধিজীবিবৃন্দ।
নিরবতা ভাঙলেন মহারাণী। সম্মানিত উপস্থিতি, আমি আমার পিতার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ সমাধা করতে চাই। এই দেশ আমাদের, এই দেশ মুজিব পরিবারের, যুগ-যুগান্তর ধরে এদেশ শাসন করবে মুজিব পরিবার, মাঝখানে যা হয়ে গেছে সেটা নিক্ষিপ্ত হবে আস্তাকুড়ে। আমরা বাহাত্তরের সংবিধান এদেশে আবার চালু করবো। এব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ চাই।

প্রথমেই হাত তোলে মতিলাল, ‘মহারাণী বাহাত্তরের সংবিধান চালু করতে হলে বাকশাল স্থাপন করতে হবে, দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করতে হবে’।
রাণী মুচকি হাসে, হাসতে হাসতেই জবাব দেয়, মতিলাল তুমি কোন দেশে আছো? বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ ছাড়া এখন আর কোন দল আছে? তুমি কি অন্ধ? সবগুলো দল অঘোশিতভাবেই নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

একবাল তুমি কিছু বলবা?
‘জ্বি রাণী সাহেবা, মোটা গোফে তা দিতে দিতে হাই তুলে একবাল। আমি বলছিলামকি বাহাত্তরেতো এতোবড় সেনাবাহিনী ছিলোনা, তখন রক্ষিবাহিনী অনেক শক্তিশালী ছিলো। ছাত্রলীগের ছেলেরা চাইলেই সেনা অফিসারদের বউ-মেয়েদের তুলে নিতে পারতো। আমি সংবিধানের মারপ্যাচ খুব একটা বুঝিনা, তবে এ বিষয়টার প্রতি লক্ষ রাখা উচিত’।
‘তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে, কিন্তু চোখে সমস্যা আছে সেটা তোমার চশমা দেখলেই বোঝা যায়। দেশে রক্ষিবাহিনী নেইতো কি হয়েছে, র‍্যাব বাহিনীতো আছে। আর সেনাবাহিনী শক্তিশালী একসময় ছিলো এখন আর সেটা নেই। ছাত্রলীগের ছেলেরা এখন আগের চাইতেও বেশি সাহসী, এখন আর তারা কাউকে তুলে আনেনা, কাউকে প্রয়োজন হলে তার বাসায় চলে যায়’।

আনিসুল হাত তুলে, রাণীমা আমি কিছু বলতে চাই।
‘তুমি এটা কি বললা আনিসুল, সার্টিফেকেট ধারী দালালকে যদি এভাবে হাত তুলে কথা বলতে হয় সেটা আমাদের জন্য লজ্জ্বার ব্যাপার। বলে ফেলো, বলে ফেলো’।
‘রাণীমা, আমাদের বন্ধু দেশ ভারত হচ্ছে সেক্যুলার রাষ্ট্র, অথচ আমাদের সংবিধানে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস রয়ে গেছে, এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, বাহাত্তরের সংবিধানেতো ইসলাম ছিলোনা’।
‘তোমার সাথে আমিও একমত, ইতোমধ্যেই সংবিধান সংশোধণ করে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস অংশটি বাদ দেয়া হয়েছে, এবং দেশব্যাপি বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে, “মহারাণীর উপর আস্থা রাখুন”। অচিরেই অন্যান্য ইসলামিক বিষয়গুলো বাদ দেয়া হবে’।

রমেশ তুমি কিছু বলবা?
‘মহারাণী লাশ লাগবে লাশ! বাহাত্তরের সংবিধান প্রতিষ্ঠা করতে হলে হাজার হাজার লাশ লাগবে। আপনার পিতার আমলে পুকুরে, নদীতে, খালে, বিলে, সব যায়গাতেই লাশ পাওয়া যেতো। মানুষ ঘৃণায় মাছ খেতোনা, কারণ মাছগুলো পঁচাগলা মানুশের লাশ খেতো’।
রাণী কিছুক্ষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন, কথা তুমি ভুল বলোনাই, কিন্তু এতো লাশ পাবো কোথায়? জামায়াত শিবিরতো সবগুলো আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। তুমি ওসমানকে একটা ফোন লাগাও’

মূহুর্তেই ওসমানকে লাইনে পাওয়া গেলো, মহারাণী কথা শুরু করলেন, হ্যা ওসমান তুমি এই মাসে কয়টা লাশ দিতে পারবা?
মহারাণীর ফোন পেয়েই ওসমানের মুখ কাঁচুমাচু হয়ে যায়, রাণিমা বড় সমস্যায় আছি, মানুষ এখন অনেক সতর্ক হয়ে গেছে, গুম করা এখন কঠিন কাজ। তারপরেও চেস্টা করলে দিনে দুই-চারটা দিতে পারবো।
‘আমি অতশত বুঝিনা, আমার লাশ চাই লাশ! যেভাবেই হোক বাহাত্তরের সংবিধান চালু করতে হবে’।
‘কিন্তু রাণীমা এতো লাশ পাবো কোথায়?’
রাণী কিছুক্ষণ চিন্তা করে, হঠাৎ করেই বলে ওঠে, ‘তুমি এক কাজ করো, আমার বাড়িতে চলে আসো, এখানে কয়েকটা লাশ আছে’। ফোন কেটে দেয় রাণী।
হতভম্ব উপস্থিতিরা চমকে ওঠে, লাশ! এখানে লাশ আসবে কোথা থেকে রাণীমা?
সেকথা পরে বলছি, আগে বলো, আমার জন্য, বাহাত্তরের সংবিধানের জন্য, জীবন দিতে রাজি আছো কে কে?
কেউ কোনো কথা বলেনা, রাণীর সন্তুষ্টির জন্য কার আগে কে হাত তুলবে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেলো।
একে একে সবার মুখের দিকে তাকালেন রাণীমা, হাসি মুখেই বললেন, গুড।
ওসমান বাহিনী কিছুক্ষনের মধ্যেই হাজির হয়ে যাবে, তোমাদের সবার জন্যই আমার শুভ কামনা রইলো। মৃত্যুর সময় যেনো তোমাদের কোনো কষ্ট দেয়া না হয় আমি সেটা বলে দিবো।
রাণীমা এটা আপনি কি বলছেন? ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো সকলের মুখ।
জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে, বাহাত্তরের সংবিধানের স্বার্থে তোমরা জীবন দিচ্ছ। ইতিহাসের পাতায় তোমাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আগামী কাল তোমাদের লাশ ভাসবে দেশের বিভিন্ন নদী-নালায়। তোমাদের হত্যার অভিযোগে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। মিডিয়াতেও ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হবে।
রাণীমার কথা শেষ হয়না, ওসমান বাহিনী হাজির হয়ে যায়, ক্ষিপ্রগতিতে হাত-পা বেধে, মুখে কাপড় ঢুকিয় স্থব্ধ করে দেয়া হয় উপস্থিত অতিথিদের। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই।

চ্যাংদোলা হয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে আনিসুলের কানে ভেসে আসে রাণিমাতার সুললিত কন্ঠের গান “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!............”

গল্পঃ সাংবিধানিক খুন
© শামীম রেজা
০৩/০৫/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment