একটি বই এবং কিছু
স্মৃতি/১৩-০৩-১৪
ক্লাসের পড়া ফাঁকি
দিয়ে গল্পের বই পড়ার নেশা ছিলো খুব, একারণে আব্বার হাতের মাইর কপালে জুটতো মাঝে মধ্যেই। আব্বার মাইরের ভয়ে কখনো
কখনো খাটের নিচে, কখনোবা কাথার নিচে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে, আবার কখনো কখনো গভীর রাতে
সবাই ঘুমিয়ে গেলে, চুপি চুপি বাতি জ্বালিয়ে গল্পের বই পড়তাম। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করা চাঁদের আলোয় বই পড়ার ইতিহাসও কম নেই।
ঠিক কবে বা কখন থেকে গল্পের বইয়ের ভূত মাথায় চেপে বসেছিলো সেটা মনে নেই, তবে বই পড়ার উৎসাহ কিংবা পারিবারিক পরিবেশ আমার ছিলোনা বললেই চলে।
নানু বাড়িতে গেলে খালাদের কাছ থেকে, আবার কখনোবা মায়ের কাছ থেকে আরব্য রজনীর গল্প শুনতাম, তখন অবশ্য জানতামনা এগুলোকে আরব্য রজনী বলে।
ঘরে একটা পুরানো বই পেয়েছিলাম, জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী”। সেটা দিয়েই সম্ভবত আমার গল্পের বই পড়ার হাতেখড়ি। তন্ময় হয়ে গল্প গুলো পড়তাম, কি বুঝতাম তা জানিনা, তবে গল্প গুলো ভালো লাগতো। মসনবী থেকেই সম্ভবত আমার গল্পের বই সংগ্রহের শুরু। তখন বই পড়ার চাইতে বই সংগ্রহ করার প্রতিই আমার মনযোগ বেশি ছিলো। পুরাতন ছেঁড়া বই গুলোকে সুন্দর করে সেলাই করে সাজিয়ে রাখতাম, আর প্রতিদিন গুণে দেখতাম কয়টা বই হলো।
প্রাইমারী স্কুল জীবনে প্রচুর পরিমাণে রুপকথার বই কিনতাম, পড়তাম। ভারতীয় কমিক বইও পড়তাম। টিফিনের টাকা বাঁচিয়েই কিনতাম গল্প-কমিক বই। “কিশোর কন্ঠের” ছিলাম অন্ধ ভক্ত, মাস শেষেই পত্রিকার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখতাম
খালাতো ভাই শাহাদাত হোসাইন একদিন শুনালেন অদ্ভুত এক বইয়ের কথা। সেই বইয়ে এক নায়ক আছে নাম “আহমদ মুসা”, হেব্বি পাওয়ার ফুল সেই নায়ক, গুন্ডারা নায়ককে বাইন্ধা রাখে, বিমানে কইরা নিয়া কোনো কোন দ্বীপে আটকাইয়া রাখে, নায়ক অনেক অনেক বুদ্ধিমান, ক্যামনে ক্যামনে জানি মুক্তি পেয়ে যায়। ছেড়া চিঠির টুকরো জোড়া লাগিয়ে উদ্ধার করে শত্রুর ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা।
হাতে তুলে নিলাম সাইমুম-১, “অপারেশন তেলআবিব” বিশাল আকাঙ্খা নিয়ে শুরু করলাম পড়া, এক পাতা, দুই পাতা এভাবে পড়ে ফেললাম বিশ-পঁচিশ পাতা। কিছুই মাথায় ঢুকেনা, প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র ছিলাম, ক্লাস থ্রি’র একটা বাচ্চা যদি অপারেশন তেল আবিব পড়া শুরু করে তাহলে অবস্থা যা হওয়ার তাই হলো। বিরক্ত হয়ে পড়া বন্ধ করে দিলাম।
ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে, আমাকে আর পায় কে! স্কুলের পাশেই নূপুর মার্কেট পুরাতন বইয়ের দোকান। গাড়ি ভাড়া আর টিফিনের টাকা মিলিয়ে আব্বা প্রতিদিন ১৫টাকা করে দিতেন। টাইগারপাস মোড় থেকে নিউমার্কেটের বাস ভাড়া ছিলো এক টাকা, যেতে আসতে দুই টাকা।
টিফিনে কিছুই খেতামনা, সেই টাকা বাঁচিয়ে প্রতিদিন একটা করে বই কিনতাম। কখনো কখনো পছন্দের বইয়ের দাম একটু বেশি হলে, বাসের পরিবর্তে আল্লাহ প্রদত্ত পা দুটোকেই ব্যবহার করতাম, বেঁচে যেতো বাস ভাড়ার দুই টাকা।
বই ছিলো আমার জন্য নেশার বস্তু, মানুষ যেমন আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, আমিও তেমনি বইয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে যেতাম। বইয়ের রাজ্যই ছিলো আমার দুনিয়া। ঘরের আনাচে কানাচে কেবল বই আর বই, বিছানার উপরে বই, জানালার উপরে বই, টেবিলের উপরেতো বই আছেই, বালিশের উপরে এবং বিছানার নিচেও বই। এলাকার অন্য ছেলেরা যখন খেলার মাঠে ব্যস্ত থাকতো আমি তখন বইয়ের সাগরে হাবু ডুবু খেতাম।
পরীক্ষার আগের রাতে গল্পের বই পড়ার রেকর্ড সম্ভবত আমার একারই আছে।
অন্যান্য দিনের মতোই একদিন গভীর রাতে চুপি চুপি উঠে গল্পের বই পড়ছিলাম, সেটা ছিলো সম্ভবত তিন গোয়েন্দা সিরিজের একটি ভলিউম। বই শেষ করতে করতে ভোর হয় হয় অবস্থা।
ঘুম ভেঙেছিলো সকাল ১০টায়, আব্বার হৈ চৈ-এর তীব্র শব্দে, আমার ক্লাসের সবগুলো বই তখন বাহিরে গড়া গড়ি খাচ্ছে, আব্বা ফেলে দিয়েছেন। তীব্র ক্ষোভে আব্বা বলছিলেন, “তোর আর লেখা পড়া করার দরকার নাই!”
আমি মনে মনে ভাবছিলাম, ইশ! সত্যিই যদি লেখা পড়াটা বন্ধ হয়ে যেতো, অনেক ভালো হতো, কোনো একটা বইয়ের দোকানে চাকরী নিয়ে নিতাম, সারাদিন শুধু গল্পের বই, অনেক অনেক মজা!
অনেক কথা বলে ফেললাম, অনেক অনেক স্মৃতিচারণ। আজকে একটি বই হাতে পেলাম, সম্পূর্ণ নতুন বই। নতুন বইয়ের কালির,কাগজের, অদ্ভুত সেই ঘ্রাণ, ফেলে আসা সেই শৈশবের ঘ্রাণ, সবই পাচ্ছিলাম এই বই থেকে, অথবা তার থেকেও কিছুটা বেশি। এবং সবচাইতে বেশি যেটা মজার, সেটা হচ্ছে এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে আমার আব্বা-আম্মাকে। এবং তার চাইতেও আনন্দের যে ব্যাপার সেটা হচ্ছে, এই বইটির লেখক আমি নিজেই, আলহামদুলিল্লাহ।
আমি জানি, আমার পাঠকরা ইতোমধ্যেই কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছেন। হ্যা, বেরিয়েছে সেই পরম আকাঙ্খিত “কারাগারের দিনগুলো” বইটি।
বই-কারাগারের দিনগুলো
প্রকাশক-ফেরদৌস বারী
প্রকাশনায়- উচ্ছ্বাস প্রকাশনী
মূল্য-১৫০
প্রাপ্তিস্থানঃ
চট্টগ্রাম-আজাদ বুকস, আন্দরকিল্লা, বিআইএ
ঢাকা-টেক্সাস কম্পিউটার্স, বাংলাবাজার
ডাক যোগে বই পেতেঃ ০১৮১৮৭৬৩৯৬৮
ঠিক কবে বা কখন থেকে গল্পের বইয়ের ভূত মাথায় চেপে বসেছিলো সেটা মনে নেই, তবে বই পড়ার উৎসাহ কিংবা পারিবারিক পরিবেশ আমার ছিলোনা বললেই চলে।
নানু বাড়িতে গেলে খালাদের কাছ থেকে, আবার কখনোবা মায়ের কাছ থেকে আরব্য রজনীর গল্প শুনতাম, তখন অবশ্য জানতামনা এগুলোকে আরব্য রজনী বলে।
ঘরে একটা পুরানো বই পেয়েছিলাম, জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী”। সেটা দিয়েই সম্ভবত আমার গল্পের বই পড়ার হাতেখড়ি। তন্ময় হয়ে গল্প গুলো পড়তাম, কি বুঝতাম তা জানিনা, তবে গল্প গুলো ভালো লাগতো। মসনবী থেকেই সম্ভবত আমার গল্পের বই সংগ্রহের শুরু। তখন বই পড়ার চাইতে বই সংগ্রহ করার প্রতিই আমার মনযোগ বেশি ছিলো। পুরাতন ছেঁড়া বই গুলোকে সুন্দর করে সেলাই করে সাজিয়ে রাখতাম, আর প্রতিদিন গুণে দেখতাম কয়টা বই হলো।
প্রাইমারী স্কুল জীবনে প্রচুর পরিমাণে রুপকথার বই কিনতাম, পড়তাম। ভারতীয় কমিক বইও পড়তাম। টিফিনের টাকা বাঁচিয়েই কিনতাম গল্প-কমিক বই। “কিশোর কন্ঠের” ছিলাম অন্ধ ভক্ত, মাস শেষেই পত্রিকার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখতাম
খালাতো ভাই শাহাদাত হোসাইন একদিন শুনালেন অদ্ভুত এক বইয়ের কথা। সেই বইয়ে এক নায়ক আছে নাম “আহমদ মুসা”, হেব্বি পাওয়ার ফুল সেই নায়ক, গুন্ডারা নায়ককে বাইন্ধা রাখে, বিমানে কইরা নিয়া কোনো কোন দ্বীপে আটকাইয়া রাখে, নায়ক অনেক অনেক বুদ্ধিমান, ক্যামনে ক্যামনে জানি মুক্তি পেয়ে যায়। ছেড়া চিঠির টুকরো জোড়া লাগিয়ে উদ্ধার করে শত্রুর ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা।
হাতে তুলে নিলাম সাইমুম-১, “অপারেশন তেলআবিব” বিশাল আকাঙ্খা নিয়ে শুরু করলাম পড়া, এক পাতা, দুই পাতা এভাবে পড়ে ফেললাম বিশ-পঁচিশ পাতা। কিছুই মাথায় ঢুকেনা, প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র ছিলাম, ক্লাস থ্রি’র একটা বাচ্চা যদি অপারেশন তেল আবিব পড়া শুরু করে তাহলে অবস্থা যা হওয়ার তাই হলো। বিরক্ত হয়ে পড়া বন্ধ করে দিলাম।
ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে, আমাকে আর পায় কে! স্কুলের পাশেই নূপুর মার্কেট পুরাতন বইয়ের দোকান। গাড়ি ভাড়া আর টিফিনের টাকা মিলিয়ে আব্বা প্রতিদিন ১৫টাকা করে দিতেন। টাইগারপাস মোড় থেকে নিউমার্কেটের বাস ভাড়া ছিলো এক টাকা, যেতে আসতে দুই টাকা।
টিফিনে কিছুই খেতামনা, সেই টাকা বাঁচিয়ে প্রতিদিন একটা করে বই কিনতাম। কখনো কখনো পছন্দের বইয়ের দাম একটু বেশি হলে, বাসের পরিবর্তে আল্লাহ প্রদত্ত পা দুটোকেই ব্যবহার করতাম, বেঁচে যেতো বাস ভাড়ার দুই টাকা।
বই ছিলো আমার জন্য নেশার বস্তু, মানুষ যেমন আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, আমিও তেমনি বইয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে যেতাম। বইয়ের রাজ্যই ছিলো আমার দুনিয়া। ঘরের আনাচে কানাচে কেবল বই আর বই, বিছানার উপরে বই, জানালার উপরে বই, টেবিলের উপরেতো বই আছেই, বালিশের উপরে এবং বিছানার নিচেও বই। এলাকার অন্য ছেলেরা যখন খেলার মাঠে ব্যস্ত থাকতো আমি তখন বইয়ের সাগরে হাবু ডুবু খেতাম।
পরীক্ষার আগের রাতে গল্পের বই পড়ার রেকর্ড সম্ভবত আমার একারই আছে।
অন্যান্য দিনের মতোই একদিন গভীর রাতে চুপি চুপি উঠে গল্পের বই পড়ছিলাম, সেটা ছিলো সম্ভবত তিন গোয়েন্দা সিরিজের একটি ভলিউম। বই শেষ করতে করতে ভোর হয় হয় অবস্থা।
ঘুম ভেঙেছিলো সকাল ১০টায়, আব্বার হৈ চৈ-এর তীব্র শব্দে, আমার ক্লাসের সবগুলো বই তখন বাহিরে গড়া গড়ি খাচ্ছে, আব্বা ফেলে দিয়েছেন। তীব্র ক্ষোভে আব্বা বলছিলেন, “তোর আর লেখা পড়া করার দরকার নাই!”
আমি মনে মনে ভাবছিলাম, ইশ! সত্যিই যদি লেখা পড়াটা বন্ধ হয়ে যেতো, অনেক ভালো হতো, কোনো একটা বইয়ের দোকানে চাকরী নিয়ে নিতাম, সারাদিন শুধু গল্পের বই, অনেক অনেক মজা!
অনেক কথা বলে ফেললাম, অনেক অনেক স্মৃতিচারণ। আজকে একটি বই হাতে পেলাম, সম্পূর্ণ নতুন বই। নতুন বইয়ের কালির,কাগজের, অদ্ভুত সেই ঘ্রাণ, ফেলে আসা সেই শৈশবের ঘ্রাণ, সবই পাচ্ছিলাম এই বই থেকে, অথবা তার থেকেও কিছুটা বেশি। এবং সবচাইতে বেশি যেটা মজার, সেটা হচ্ছে এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে আমার আব্বা-আম্মাকে। এবং তার চাইতেও আনন্দের যে ব্যাপার সেটা হচ্ছে, এই বইটির লেখক আমি নিজেই, আলহামদুলিল্লাহ।
আমি জানি, আমার পাঠকরা ইতোমধ্যেই কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছেন। হ্যা, বেরিয়েছে সেই পরম আকাঙ্খিত “কারাগারের দিনগুলো” বইটি।
বই-কারাগারের দিনগুলো
প্রকাশক-ফেরদৌস বারী
প্রকাশনায়- উচ্ছ্বাস প্রকাশনী
মূল্য-১৫০
প্রাপ্তিস্থানঃ
চট্টগ্রাম-আজাদ বুকস, আন্দরকিল্লা, বিআইএ
ঢাকা-টেক্সাস কম্পিউটার্স, বাংলাবাজার
ডাক যোগে বই পেতেঃ ০১৮১৮৭৬৩৯৬৮
No comments:
Post a Comment