ফেরাউনকে আমার হিংসে হয়।


ফুলকুঁড়ি আসরের একটা অনুষ্ঠান দেখেছিলাম, সেখানে এক শিশু বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিলো। শিশু বিশেষজ্ঞ বলতে, সেই বিশেষজ্ঞ নিজেই একজন শিশু!!
যাই হোক, শিশু বিশেষজ্ঞকে এক অভিভাবক প্রশ্ন করলেন, আমার বাচ্চা খেতে চায়না, এর সমাধান কি?
বিশেষজ্ঞ মজার জবাব দিয়েছিলেন, বাচ্চারা খেতে চায়না কথাটা ভুল, সঠিক কথা হলো, বাচ্চারা যা খেতে চায় আমরা তা খেতে দেইনা। যেমন চকলেট,আইসক্রিম,আচার,চিপস আরো কতো কি!!

আমার আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন সবারই একই অভিযোগ, আমি ঠিকমতো খাইনা, না খেয়ে খেয়ে দিন দিন সুটকি হয়ে যাচ্ছি। আমি খাইনা কথাটা ভুল, আমিতো অনেক কিছুই খাই, যেমন রংপুরে গেলে অবশ্য অবশ্যই সুপার মার্কেটের চটপটি খাই, মাদারীপুর গেলে সেই বিখ্যাত রসগোল্লা মিস করার প্রশ্নই আসেনা।
ঢাকায় গেলে, ফুটপাত থেকে হরকে রকমের ভর্তা দিয়ে ঝাঁল ঝাঁল চিতই পিঠা অবশ্যই খাই। আর কুমিল্লার টাউন হল মাঠের গরুর নলার হালিমতো আমার জিভে পানি এনে দেয়। আর যেটা খাইনা সেটা হচ্ছে বগুড়ার দই এবং কুমিল্লার রসমালাই, এই দুইটা জিনিস নাকি বিখ্যাত, অথচ আমার কাছে অখাদ্যই মনে হয়। এর চাইতে ঘরে বানানো চিনি মেসানো কাঁচা দইতো অতুলনীয়!

অন্যান্য সময়ের মতোই, কুমিল্লা নেমেই চলে গেলাম কান্দির পাড় টাউন হল মাঠে। আয়েশ করে বসে বসে হালিম খাচ্ছিলাম, সেই প্রিয় নলার হালিম! পেছন থেকে মাঝ বয়সি এক মহিলা ভিক্ষুক সুর করে বলছিলেন, “কত টাকা কত যায়গায় খরচ করি, কিছু টাকা দান করেন এই টাকা বৃথা যাবেনা, আখিরাতে এই টাকা পাওয়া যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি”। মহিলার কথাগুলো মনে দাগ কাটলো, পকেট থেকে খুচড়া কয়েকটা টাকা দিয়ে দিলাম, সাথে এটাও বললাম, দোয়া কইরেন!
“দোয়া কইরেন” শব্দটা আমি সচেতনভাবে বলিনাই, এটা আমার মুদ্রাদোষ! কাউকে বিদায় দেয়ার সময় আপনা আপনিই এই কথাটা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায়।
মহিলা দোয়া করতে শুরু করলেন, “আল্লাহ মনের আশা পূরণ করুক, আপনারে জীবনে সুখ-শান্তি দান করুক, মনের কষ্ট দূরে করে দিক”
দোয়া শুনে আমার কি যে হলো, মনে হচ্ছিলো আমার দোয়া গুলোই মহিলার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। একবার ভাবলাম, মহিলাকে বলি, খালা চেয়ার টেনে বসেন, হালিম খাবেন? পরক্ষণেই সচেতন জগতে ফিরে এলাম, আমিতো সুস্থ সমর্থ কোনো মানুষকে ভিক্ষা দেইনা! এই মহিলাকে কেনো দিলাম?

চিন্তাটা বারবারই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো, এই মহিলাকে আমি কেনো ভিক্ষা দিলাম! কোথায় যেনো একটা গান শুনেছিলাম, “চাওয়ার মতো চাইলে খোঁদা সাড়া দিবেনা কেনো” টাইপের। ওই মহিলার চাওয়ার স্টাইলটা সুন্দর ছিলো যেটা হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে, মন নরম করে দিয়েছে, তাই না দিয়ে উপায় ছিলোনা।
পরক্ষণেই একটা ব্যাপার মাথায় গেথে গেলো, সেটা হচ্ছে, মানুষের এতো এতো কঠিন মন যদি কারো কথায় নরম হয়ে যেতে পারে, তাহলে সেই রহিম-রহমান কেনো মানুষের দোয়া কবুল করেননা? তিনিতো পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু!

হ্যা, অবশ্যই তিনি সাড়া দিবেন, আমরা আসলে চাওয়ার মতো চাইতে পারিনা। একবার জুমার খুতবায় ইমাম সাহেবের বক্তব্যে শুনেছিলাম, ফেরাউন নাকি আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ ফিরিয়ে দিতে পারতেননা। তার চাওয়ার স্টাইল ছিলো ব্যাতিক্রম, ফেরাউন যখন নিজেকে আল্লাহ দাবী করেছিলো তখন নীল নদের স্রোত বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। প্রজা সাধারণ ফেরাউনের কাছে আসলো, এসে বললো আপনিতো নিজেকে আল্লাহ দাবী করেন, এবার নীল নদের স্রোত এনে দেন।
ফেরাউন পড়ে গেলেন বিপদে, গভীর রাতে এক জঙ্গলে চলে গেলেন, সেখানে গিয়ে করুণভাবে কান্নাকাটি করে আল্লাহকে বললেন, হে আল্লাহ আমার সম্মান তুমি ছিনিয়ে নিওনা, আমি তওবা করতেছি, আমি আর শিরক করবোনা, তুমি নীল নদের স্রোত ফিরিয়ে দাও।
আল্লাহ ফিরাউনের দোয়া কবুল করেছিলেন, নীল নদের স্রোত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ফেরাউন তখন দম্ভ করে জনগণকে বলেছিলো, আমার ক্ষমতা সম্পর্কে তোমাদের আর কোনো সন্দেহ আছে? আমার হুকুমেই নীল নদের স্রোত ফিরে এলো।

দোয়া কবুল সম্পর্কে আরেকটা মজার গল্প, এক বেনামাজী লোক শুনেছিলেন, দোয়া কবুলের কোন এক রাতে আল্লাহর কাছে যা চাইবে তাই পাওয়া যাবে। সেই লোক ভালোমতো ওজু-গোসল সম্পন্ন করে বিশাল এক পাথর এনে মসজিদের দরজার সামনে রেখে দিলো, তারপরে শুরু করলো দোয়া। করুণভাবে আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি, হে আল্লাহ তুমি এই বিশাল পাথরটাকে হীরায় রুপান্তরিত করে দাও!
লোকটা দোয়া করে আর বার বার পেছনে ফিরে দেখে, পাথরটা হীরা হয়ে গেলো কিনা!
এদিকে ভোর হয় হয় অবস্থা! সে এবার এক ধাপ নিচে নেমে গেলো, আল্লাহ যদি হীরা না হয় অন্তত এটাকে স্বর্ণে রুপান্তরিত করে দাও।
সময় গরিয়ে যায়, পাথর স্বর্ণ হয়না, লোকটা ধীরে ধীরে আরো কমিয়ে চায়, হীরা থেকে স্বর্ণ, স্বর্ণ থেকে রুপা। ফজরের সময় আসন্ন প্রায়, অধৈর্য হয়ে এক পর্যায়ে এসে লোকটি বললো, আল্লাহ অন্তত পক্ষে পাথরটাকে তুমি লোহা বানিয়ে দাও!
কি অদ্ভুত ব্যাপার, পাথরটি লোহায় রুপান্তরিত হয়ে যায়! লোকটি তাজ্জব হয়ে বসে থাকে। ফজরের সময় ঈমাম সাহেব মসজিদে আসলে তাকে ঘটনা খুলে বলে, আমি এতো কিছু চাইলাম, আল্লাহ দিলোনা, লোহা চাইলাম দিয়ে দিলো, এটার কারণ কি?
ইমাম সাহেব ঘটনার ব্যাক্ষা এভাবে দিলেন, সারারাত দোয়া করার ফলে, আপনার সাথে আল্লাহর বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গিয়েছিলো, যে মূহুর্তে আপনি লোহা চেয়েছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে আপনি যদি আরো বাড়িয়ে বেহেশতও চাইতেন, তবে আল্লাহ আপনাকে বেহেশত প্রদান করতেন! কিন্তু দূর্ভাগ্য, আপনি লোহা চেয়েছেন! আল্লাহ আপনাকে লোহা দিয়েছেন!

ছোট বেলা হতে নাচাইতেই অনেক কিছু পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। চাওয়ার পরেও পাইনি এমনটা যখনি হয়েছে তখনি মনকে সান্তনা দিয়েছি, আঙুর ফল টক! আবার কখনোবা বলেছি, আঙুর ফল অনেক মিষ্টি আমার দাতেই সমস্যা, তাই খেতে পারছিনা। কিন্তু কখনো আল্লাহর কাছে সেভাবে চাইনি, চাইতে পারিনাই, যেভাবে চাইলে পাওয়া যায়।
সত্যিই ফেরাউনকে আমার হিংসা হয়, আল্লাহদ্রোহী হওয়ার পরেও কিভাবে আল্লাহর কাছে চাইতে পারতো!

লেখাঃ ফেরাউনকে আমার হিংসে হয়।
© শামীম রেজা
২৩/০৩/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment