কারাগারের দিনগুলো, বই হাতে মাহফুজ আলম ভাই।



একদল শিবির নেতাকর্মী নিয়ে দুলাভাই এসে হাজির হলেন ১৮তারিখ বিকেল বেলায়, সাথে সিটি কর্পোরেশনের জামায়াত সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহফুজ আলম ভাই। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো, তিনি পারিবারিক ভাবে মামলা পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হলো ব্যাপারটি জটিল হয়ে যাবে, আমাদের নিজস্ব আইনজীবি আছেন তারা এব্যাপারে দক্ষ। কট্টর লীগ সমর্থক আমার এই ভাই, সরকারী অফিসার হওয়ার কারণে এখন প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতে না পারলেও একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আমার হাসিখুশি চেহারা দেখে কিছুটা অবাক হয়েই বললেন, তুমিতো মনে হচ্ছে ভেতরে খুব আনন্দেই আছো, ওদিকে বাড়িতেতো কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেছে, তোমার বোন খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে!

ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহফুজ আলম ভাইয়ের সাথেও কুশল বিনিময় হলো, একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে যতরকম গুণাবলী দরকার সবগুলোই এই মানুষটার মধ্যে বিদ্যমান, মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহ তাকে রাজনীতি করার জন্যই বোধহয় দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন! বয়সে নবীন এই মানুষটি আওয়ামী অধ্যুষিত এলাকায় তিন তিনবার নির্বাচিত আওয়ামীলীগের শক্তিশালী প্রার্থিকে পরাজিত করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। সবচাইতে অবাক ব্যাপার হচ্ছে জামায়াত প্রার্থী হওয়া সত্বেও তিনি হিন্দু ভোটারদেরও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। তার নির্বাচনী এলাকাতে গত দুই বছরে তিনি যতগুলো সমাজসেবা মূলক কাজ করেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই এলাকায় এত কাজ হয়নি। ২২তারিখে পরীক্ষার আগেই জামিনের চেস্টা চলছে জানিয়ে তারা বিদায় নিলেন।

সাক্ষাৎ শেষে ফুরফুরে মেজাজে ওয়ার্ড এসে আড্ডায় ডুবে যেতাম, কখনো ৭নম্বর ওয়ার্ড কখন আনোয়ার ভাইয়ের ১২নম্বরে কিংবা হোসাইন ভাইয়ের ১৪নম্বরে, আর রেগুলার ডিউটি হিসেবে বদিউর রহমান ভাইয়ের রুমতো আছেই। জেল জীবনে অনেক ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, তাদের একেক জনের ঘটনা লিখতে গেলে একেকটা জনপ্রিয় নাটকে পরিণত হবে।

৮নম্বর ওয়ার্ডে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো দেলাওয়ার ও সালাউদ্দীনের সাথে, দুজনেই পটিয়ায় হিন্দু মন্দির ভাংচুর মামলার আসামী। ৭নম্বর ওয়ার্ডের তারেক ও মোর্শেদ, তারেক আমার কলেজ লাইফের বন্ধু, জোড়পূর্বক পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়ে অপহরণ মামলার আসামী। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর ডানহাত হিসেবে পরিচিত রাউজানের বিধান বড়ুয়ার সাথে, তার নামে সম্ভবত ৭২টি মামলা, কারাগারের সবাই তার সাথে হিসেব করে কথা বলে! আরো পরিচিত হয়েছিলাম মীরসরাই ট্রাজেডির সেই ট্রাক ড্রাইভারের সাথে, যার ভুলের কারণে ঝড়ে গেলো ৪৫টি শিশুর তাজা প্রাণ। আপনারা অনেকেই হয়তো রসু খাঁর নাম শুনে থাকবেন, হ্যা আমি সেই রসু খাঁর কথাই বলছি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সিরিয়াল কিলার, তিনি আমার পাশের ওয়ার্ডেই ছিলেন, কয়েকবার তার সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। যারা রসু খাকে চিনতে পারেননাই তারা গুগলে সার্চ দিতে পারেন।

৭নম্বর ওয়ার্ডে পরিচয় হয়েছিলো ফয়সলের সাথে, অপহরণ মামলার আসামী। রিমান্ডের আগেই পিটিয়ে ছেলেটির হাতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে পুলিশ। ফয়সলের বন্ধু প্রেম করতো একটি মেয়ের সাথে, ফয়সল টুকটাক দালালী করতো বন্ধুর জন্য। একদিন বন্ধু লুকিয়ে বিয়ে করে, মেয়েটিকে হানিমুনে নিয়ে যায় কক্সবাজারে। মেয়ের বাপ দেয় অপহরণ মামলা, আর ফয়সলের হানিমুন এই ৭নম্বর ওয়ার্ড। সারাদিন ভুস ভুস করে বিড়ি টানতো আর কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান, ভাইয়া আমার জামিন হবেতো?

বইঃ কারাগারের দিনগুলো (২৮-২৯পৃষ্ঠা)
লেখকঃ শামীম রেজা
 


Photo: একদল শিবির নেতাকর্মী নিয়ে দুলাভাই এসে হাজির হলেন ১৮তারিখ বিকেল বেলায়, সাথে সিটি কর্পোরেশনের জামায়াত সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহফুজ আলম ভাই। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো, তিনি পারিবারিক ভাবে মামলা পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হলো ব্যাপারটি জটিল হয়ে যাবে, আমাদের নিজস্ব আইনজীবি আছেন তারা এব্যাপারে দক্ষ। কট্টর লীগ সমর্থক আমার এই ভাই, সরকারী অফিসার হওয়ার কারণে এখন প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতে না পারলেও একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আমার হাসিখুশি চেহারা দেখে কিছুটা অবাক হয়েই বললেন, তুমিতো মনে হচ্ছে ভেতরে খুব আনন্দেই আছো, ওদিকে বাড়িতেতো কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেছে, তোমার বোন খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে!

ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহফুজ আলম ভাইয়ের সাথেও কুশল বিনিময় হলো, একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে যতরকম গুণাবলী দরকার সবগুলোই এই মানুষটার মধ্যে বিদ্যমান, মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহ তাকে রাজনীতি করার জন্যই বোধহয় দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন! বয়সে নবীন এই মানুষটি আওয়ামী অধ্যুষিত এলাকায় তিন তিনবার নির্বাচিত আওয়ামীলীগের শক্তিশালী প্রার্থিকে পরাজিত করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। সবচাইতে অবাক ব্যাপার হচ্ছে জামায়াত প্রার্থী হওয়া সত্বেও তিনি হিন্দু ভোটারদেরও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। তার নির্বাচনী এলাকাতে গত দুই বছরে তিনি যতগুলো সমাজসেবা মূলক কাজ করেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই এলাকায় এত কাজ হয়নি। ২২তারিখে পরীক্ষার আগেই জামিনের চেস্টা চলছে জানিয়ে তারা বিদায় নিলেন।

সাক্ষাৎ শেষে ফুরফুরে মেজাজে ওয়ার্ড এসে আড্ডায় ডুবে যেতাম, কখনো ৭নম্বর ওয়ার্ড কখন আনোয়ার ভাইয়ের ১২নম্বরে কিংবা হোসাইন ভাইয়ের ১৪নম্বরে, আর রেগুলার ডিউটি হিসেবে বদিউর রহমান ভাইয়ের রুমতো আছেই। জেল জীবনে অনেক ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, তাদের একেক জনের ঘটনা লিখতে গেলে একেকটা জনপ্রিয় নাটকে পরিণত হবে। 

৮নম্বর ওয়ার্ডে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো দেলাওয়ার ও সালাউদ্দীনের সাথে, দুজনেই পটিয়ায় হিন্দু মন্দির ভাংচুর মামলার আসামী। ৭নম্বর ওয়ার্ডের তারেক ও মোর্শেদ, তারেক আমার কলেজ লাইফের বন্ধু, জোড়পূর্বক পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়ে অপহরণ মামলার আসামী। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর ডানহাত হিসেবে পরিচিত রাউজানের বিধান বড়ুয়ার সাথে, তার নামে সম্ভবত ৭২টি মামলা, কারাগারের সবাই তার সাথে হিসেব করে কথা বলে! আরো পরিচিত হয়েছিলাম মীরসরাই ট্রাজেডির সেই ট্রাক ড্রাইভারের সাথে, যার ভুলের কারণে ঝড়ে গেলো ৪৫টি শিশুর তাজা প্রাণ। আপনারা অনেকেই হয়তো রসু খাঁর নাম শুনে থাকবেন, হ্যা আমি সেই রসু খাঁর কথাই বলছি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সিরিয়াল কিলার, তিনি আমার পাশের ওয়ার্ডেই ছিলেন, কয়েকবার তার সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। যারা রসু খাকে চিনতে পারেননাই তারা গুগলে সার্চ দিতে পারেন।

৭নম্বর ওয়ার্ডে পরিচয় হয়েছিলো ফয়সলের সাথে, অপহরণ মামলার আসামী। রিমান্ডের আগেই পিটিয়ে ছেলেটির হাতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে পুলিশ। ফয়সলের বন্ধু প্রেম করতো একটি মেয়ের সাথে, ফয়সল টুকটাক দালালী করতো বন্ধুর জন্য। একদিন বন্ধু লুকিয়ে বিয়ে করে, মেয়েটিকে হানিমুনে নিয়ে যায় কক্সবাজারে। মেয়ের বাপ দেয় অপহরণ মামলা, আর ফয়সলের হানিমুন এই ৭নম্বর ওয়ার্ড। সারাদিন ভুস ভুস করে বিড়ি টানতো আর কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান, ভাইয়া আমার জামিন হবেতো?

বইঃ কারাগারের দিনগুলো (২৮-২৯পৃষ্ঠা)
লেখকঃ শামীম রেজা

Post Comment

No comments:

Post a Comment