হাটা বাবা এবং ঢাকা ভ্রমণ


ঢাকা শহরে এক বাবা ছিলেন, নাম হাঁটা বাবা! এই হাঁটা বাবা পথে প্রান্তরে হাঁটতেন, তার সাথে সাথে হাঁটতেন অসংখ্য ভক্ত! বেশ কিছুদিন আগে এই হাঁটা বাবা মারা গেলেন, পত্রিকায় দেখলাম, তার জানাযায় নাকি সারা ঢাকা শহর থেকে হাজার দশেক ভক্ত যোগ দিয়েছিলো এবং লাশের কবর কোথায় হবে তা নিয়ে সৃষ্টি হয় বিরাট হাঙ্গামা, পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়।

মাঝে মাঝে মনে হয়, হাঁটা বাবার এই হাঁটা-হাঁটির বৈশিষ্ট্যটা আমার মধ্যে প্রবল। মাঝে মধ্যেই মনের মতো কাউকে পেলে হাঁটতে থাকি, হাঁটতে হাঁটতেই পাড়ি দেই মাইলের পর মাইল পথ। চট্টগ্রামে আমার এই হাঁটার সঙ্গী হলো বন্ধু আলী, আর ঢাকায় এলে খালাতো ভাই জামান।

২০০৩ সালে এসএসসি দিয়ে তিন মাসের বন্ধ, গায়ে নতুন বাতাস, কিছুদিন পরেই কলেজে ভর্তি হবো, গোটা দুনিয়াকেই রঙিণ দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলাম। তিনটা মাস কাটিয়ে দিলাম হাঁটতে হাঁটতেই। ঝাউতলা রেলষ্টেশন হতে চট্টগ্রাম ভার্সিটির রেলপথে দূরত্ব প্রায় এক ঘন্টা, জামানকে বলতেই রাজি হয়ে গেলো, মনে এ্যাডভেঞ্চারের নেশা, হেঁটে হেঁটেই চলে গেলাম ভার্সিটি। সকাল দশটা হতে দুপুর দুইটা পর্যন্ত এক নাগাড়ে চার ঘন্টা হাঁটা!
ভার্সিটি লাইফেও সেই একই অবস্থা, সঙ্গী বন্ধু আলী আর প্রাণভরা কথা। কত কথা, কত স্মৃতি এই হাঁটার মধ্যেই বিনিময় হয় তার হিসেব কে রাখে?

ঢাকা এসেছি বুধবার, হাতে অনেক কাজ, দীর্ঘ সিডিউল। বুধবার সন্ধ্যায়ই চলে গেলাম মারদিয়া আপার বাসায়, সঙ্গী হলেন মাসুদ হাসান ভাই। মারদিয়া আপার আপ্যায়নের ব্যাপারে বলার আগে একটা গল্প বলে নেই। চটগ্রামে আমাদের বড় ভাই সালেহ আহম্মদ একটা ইসলামী সংগঠনের সাথে জড়িত, তো সেই সংগঠনের যেকোনো প্রগ্রামেই প্রচুর আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকে। ছাত্র রাজনীতি করে যাওয়া সালেহ ভাইয়ের কাছে ব্যাপারটা কিছুটা অদ্ভুতই লাগলো। একটা প্রগ্রামে সালেহ ভাই বলেই ফেললেন, আমার একটা প্রশ্ন আছে!
দায়িত্বশীল জিজ্ঞাসা করলেন কি প্রশ্ন?
সালেহ ভাই বললেন, এই যে প্রতিটা প্রগ্রামে আমরা এতো খাওয়া.........
দায়িত্বশীল মাঝপথেই হাসতে হাসতে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মান্না-সালওয়া নিয়ে প্রশ্ন করতে নেই, বন্ধ হয়ে যাবে, তার চাইতে খাইতে থাকেন!
মারদিয়া আপার আপ্যায়নের ব্যাপারে আমিও কোনো প্রশংসা করলামনা, আমি খাইতে থাকলাম, দোয়া করি প্রতিবার ঢাকায় এসে যেনো খাইতে পারি!

এবার মারদিয়া আপার বাসার একটু প্রশংসা করি। এমন সাজানো গোছানো রুচিশীল জিনিসপত্রে ঠাঁসা বাসা আমি খুব কমই দেখেছি। বইয়ের র‍্যাকগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো, মাথায় তুলে নিয়ে আসি! আর ছাঁদ? মাশাআল্লাহ! ঢাকা শহরে এমন বাসা থাকতে পারে, আমার কল্পনার বাহিরে ছিলো। উথাল-পাথাল হাওয়া, আকাশে বিশাল চাঁদ, রাতের বিজলী বাতিতে বিশাল ঢাকা শহর, খুবাইব আর খাদিজার ছোটাছুটি এবং সিমেন্টের টবে বেড়ে ওঠা মাঝাড়ি আকৃতির গাছ, বেতের চেয়ারে বসে নাস্তা! অন্য রকম, অন্য রকম এক অনুভূতি। চট্টগ্রামের বাটালি পাহাড়ে যারা উঠেছেন তাদের উদ্দেশ্য বলছি, মনে হচ্ছিলো বাটালি পাহাড়ে রাতের বেলা পিকনিক করছি!!

অনেক গল্প হলো, খুবাইব-খাদিযাহ’র আব্বু কাসেম ভাই এবং মারদিয়া আপার আব্বু মমতাজ চাচার সাথে। মমতাজ চাচা দেখলাম, আমাকে ভালো করেই চিনেন, আমার লেখার সাথে তার পরিচয় বহুদিনের। তার প্রশংসা শুনে লজ্বায় আমার কান গরম হয়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা, লজ্বায় কি কান গরম হয়? আমার হয়, কেনো হয় সেটা অবশ্য জানিনা।

গতরাতটা ছিলো অন্য রকম এক রাত, সমগ্র ঢাকা শহর যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, আমরা তখন হাঁটতে বেড়োলাম। আমরা বলতে, আমি আর জামান। জামানের সাথে আমার অদ্ভুত একটা ব্যাপার হয়, সেটা হচ্ছে, আমাদের কথা কখনো শেষ হয়না, আমরা অনর্গল কথা বলতেই থাকি, আমরা ক্লান্ত হইনা। ফ্লুরোসেন্ট লাইটের হলদেটে আলোয় রাজপথ, সাঁই সাঁই করে ছুটে চলা গাড়ি, উথাল-পাথাল হাওয়া, ফুটপাতে ঘুমন্ত মানুষ, আর আমাদের আয়েশি পথচলা, অবিরাম কথামালা। দাড়ি-কমা বিহীন আমাদের সেই কথামালায় কখনো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি, আবার কখনোবা চোখ ভাসে, গলা ভেজে, মন ভাঙে।
আমরা অবিরাম হেঁটে চলি, গল্প করি, কথা বলি, হৃদয়ের কথা, প্রাণের কথা, হাঁসি-আনন্দ, সব সব। কথা বলে আমরা হালকা হই, যতটা হালকা হলে বাতাসে ভাসা যায়......

লেখাঃ হাটা বাবা এবং ঢাকা ভ্রমণ
© শামীম রেজা।
২১/০৩/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment