কোন এক বিখ্যাত অভিনেতাকে একবার সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলো, আপনার জীবনের প্রথম অভিনয় সম্পর্কে বলেন।
ওই চলচিত্র অভিনেতা খুব আক্ষেপ করে বলছিলেন, আমার প্রথম অভিনয় করা চলচিত্রটি আমি দেখতে পারিনাই!
হতভম্ব সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করলেন, এটা কিভাবে সম্ভব?
ওই অভিনেতার নির্লিপ্ত জবাব, সেটা ছিলো প্রাপ্তবয়স্কদের চলচিত্র, আর আমি ছিলাম শিশু!
বিজলী বাতি হতে বহুদূরে, ছাঁদ খোলা নৌকায় শুয়ে শুয়ে রাতের আকাশ দেখার মজাই আলাদা। দক্ষিণাঞ্চলে গ্রামের বাড়ি হওয়ার সুবাদে এই সৌভাগ্য আমার প্রায়ই হয়। এমনই এক রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম, শাপলা শালুকের বিলে, ঝিড়ি ঝিড়ি হাওয়া আর অগণিত নক্ষত্রের মাঝে যখন উদাস হয়ে ভাবের জগতে চলে গেলাম, ঠিক তখনি সহযাত্রির মোবাইলে বেজে উঠলো একটি গান—
"কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া, আমার ভাইধন রে কইয়ো নাইওর নিতো বইলা, তোরা কে যাস কে যাস। বছর খানি ঘুইরা গেল গেল রে, ভাইয়ের দেখা পাইলাম না, পাইলাম না"।
গানটি শুনছিলাম আর নিজের বোনের কথাই বারবার মনে পড়ছিলো, সত্যিই ভাই-বোনের এই ভালোবাসা অকৃত্রিম, অক্ষয়।
সুযোগ পেলেই বড় আপার বাসায় চলে যাই, এবং এই যাওয়াটা যতটানা আপার প্রতি টান, তার-চাইতেও বেশি সম্ভবত কচি কচি কন্ঠের মামা ডাক শোনার আকুলতা এবং আপার হাতের মজাদার রান্না! এবারো ব্যতিক্রম হলোনা, প্রথম বই ( কারাগারের দিনগুলো ) প্রকাশিত হওয়ার পরেই চলে গেলাম আপার বাসায়।
প্রকাশিত বইয়ের প্রথম আট-দশ পাতা পড়ে আওয়ামী সাপোর্টার দুলাভাই নির্লিপ্ত!
বড় ভাগ্নীটা অনুযোগের সুরেই বললো, মামা এগুলা তুমি কি লেখ?
“কেনো মামা, কি হয়েছে?”
“আমার মামা যে একজন লেখক, আমার মামার যে একটা বই বের হয়েছে, এটা আমার বান্ধবীদের কাছে বলতেও পারবোনা, আর কাউকে দেখাতেও পারবোনা। কি সব রাজনৈতিক লেখা লিখছো! রাজনীতি ছাড়া লিখতে পারোনা?”
ভাগ্নে-ভাগ্নীদের কাছে তাদের মামারা হচ্ছেন সুপারম্যান, মামাদের সম্পর্কে বন্ধুদের কাছে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে না পারলে ভাইগ্না-ভাগ্নীদের পেটের ভাত হজম হয়না এটা আমি ভালো করেই বুঝি।
আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলামনা।
ছোট বেলায় বন্ধুদের কাছে গল্প করতাম, “জানো, আমার মামা শিবির করে, মামা শিবিরের বিশাল নেতা, আমার মামার অনেক শক্তি! ঢিশুম! ঢিশুম!
আমার মামার সাথে কেউ তেড়ি বেড়ি করলে মামা তাদের রগ কেটে দেয়। না না, সবার রগ কাটেনা, যারা কান্নাকাটি করে, ক্ষমা চায়, তাদের মাফ করে দেয়। আমার মামা অনেক ভালো!”
ভাগ্নীকে আশ্বস্ত করলাম, আগামী বই মেলায় অরাজনৈতিক গল্পের বই প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহ। তখন তুমি সবাইকে বলতে পারবে, এটা আমার মামার লেখা বই!
ল্যাপটপে কাজ করছিলাম, ক্লাস ওয়ান পড়ুয়া ছোট ভাইগ্না এসে বললো, মামা একটা কথা বলি?
“হ্যা মামা বলো”।
“মামা, কানে কানে বলি?”
কী-বোর্ড টিপতে টিপতেই বললাম, আচ্ছা বলো।
ভাইগ্না কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললো, মামা তুমি কি ডাকাত?
“কেনো মামা, এই প্রশ্ন কেনো?”
“তোমাকে যে পুলিশে নিয়ে গেছে, তুমি যে জেলে ছিলা?!”
বুঝলাম, ভালোই মাইঙ্কার চিপায় পড়েছি, কালকে হয়তো আমার এই ভাইগ্না স্কুলে গিয়ে তার বন্ধুদের সাথে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করবে, “জানো, আমার মামা শিবির করে, মামা মস্ত বড় ডাকাত! সিনেমার নায়কদের মতো করে সুরঙ্গ দিয়ে সোনালি ব্যাঙ্কের সব টাকা ডাকাতি করেছিলো। মামাকে পুলিশে ধরেছিলো, আমার মামার অনেক শক্তি, মামা জেল ভেঙ্গে বেড়িয়ে এসেছে! ঢিশুম! ঢিশুম!”
মনে মনে দোয়া করছিলাম, এমনিতেই উঠতে বসতে আব্বা আমাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করে, এই বই আব্বার হাতে গেলে আমার অবস্থা কেরোসিন!
জোহরের আজান দিতেই ছোট ভাগ্নী জায়নামায নিয়ে হাজির, এখনো কথা বলতে শিখেনাই, আমার হাতে জায়নামায ধরিয়ে দিয়ে বলছে, মাম্মমা ওই নামাজ! মাম্মা, মাম্মা!
“আচ্ছা মামা নামাজ পড়বো, গোসল করে নেই”।
ভাগ্নী কথা শুনতে নারাজ, হৈ চৈ শুরু করে দিলো, এখনই নামায পড়তে হবে। আধো আধো স্বরে মাম্মা, মাম্মা, ডাকছে আর হাত ধরে টানছে।
অগ্যতা উঠে গিয়ে জায়নামায বিছিয়ে দিলাম, ভাগ্নী সরাসরি সিজদায়, সিজদা দিয়ে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখছে! এরপর শুরু হলো ননস্টপ সিজদা, কোনো থামা থামি নাই!
দুপুর বেলা আপা গেলো ভাগ্নিকে ঘুম পাড়াতে, ভাগ্নীকে ঘুম পাড়িয়ে আমার সাথে গল্প করবে। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম সাড়া ঘরময় ভাগ্নীর ছোটাছুটি!
ব্যাপার কি? একটু পরেই বুঝতে পারলাম আসল কাহিনী, ভাগ্নীই বরং আপাকে ঘুম পাড়িয়ে চলে এসেছে!
বিকালে শুরু হলো লুঙ্গি ড্যান্স! ছোট ভাইগ্না টিভিতে “লুঙ্গি ড্যান্স” গান চালু করেছে, আর পিচ্চি ভাগ্নীটা সেই গানের তালে তালে ড্যান্স দিচ্ছে। ভাগ্নীর পড়নে লুঙ্গি নাই, তাই জামাকেই লুঙ্গির মতো ধরে লাফাচ্ছে!
প্রথমে টিভি বন্ধ করে দিলাম, ভাগ্নীর চিৎকার কান্নাকাটিতে কান ঝালাপালা। বাধ্য হয়ে আবার টিভি চালু এবং লুঙ্গি ড্যান্স!
আপাকে ডেকে দেখালাম, বাচ্চারা এগুলো কি শিখছে? ছোট বেলা হতেই অশ্লীলতা দেখে দেখে বড় হলে ভালো খারাপের পার্থক্য করবে কিভাবে?
আপা ঘোষণা দিলেন, এই মাসেই ডিস কানেকশন অফ করে দেয়া হবে। ডিসকানেকশন অফ করে দিলে সমস্যার সমাধান হবেনা, তারচাইতে বরং চ্যানেল চাইল্ড লক করে দিলেই ভালো হয়।
আপার বাসা থেকে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম, ছোট ভাগ্নীটা তখন চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিলো, তার সেই গগন বিদারী চিৎকারে কানে তালা লাগার যোগার, “মামা যাবো, মামা যাবো”।
কোনো রকমে ফাঁকি দিয়ে চলে এলাম।
সব আপন মানুষেরা যদি ছোট ভাগ্নীটার মতো হতো! প্রিয় মানুষের কান্নাও কখনো কখনো দেখতে ইচ্ছে করে।
লেখাঃ আমি একজন মামা
© শামীম রেজা
২৫/০৩/২০১৪
ওই চলচিত্র অভিনেতা খুব আক্ষেপ করে বলছিলেন, আমার প্রথম অভিনয় করা চলচিত্রটি আমি দেখতে পারিনাই!
হতভম্ব সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করলেন, এটা কিভাবে সম্ভব?
ওই অভিনেতার নির্লিপ্ত জবাব, সেটা ছিলো প্রাপ্তবয়স্কদের চলচিত্র, আর আমি ছিলাম শিশু!
বিজলী বাতি হতে বহুদূরে, ছাঁদ খোলা নৌকায় শুয়ে শুয়ে রাতের আকাশ দেখার মজাই আলাদা। দক্ষিণাঞ্চলে গ্রামের বাড়ি হওয়ার সুবাদে এই সৌভাগ্য আমার প্রায়ই হয়। এমনই এক রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম, শাপলা শালুকের বিলে, ঝিড়ি ঝিড়ি হাওয়া আর অগণিত নক্ষত্রের মাঝে যখন উদাস হয়ে ভাবের জগতে চলে গেলাম, ঠিক তখনি সহযাত্রির মোবাইলে বেজে উঠলো একটি গান—
"কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া, আমার ভাইধন রে কইয়ো নাইওর নিতো বইলা, তোরা কে যাস কে যাস। বছর খানি ঘুইরা গেল গেল রে, ভাইয়ের দেখা পাইলাম না, পাইলাম না"।
গানটি শুনছিলাম আর নিজের বোনের কথাই বারবার মনে পড়ছিলো, সত্যিই ভাই-বোনের এই ভালোবাসা অকৃত্রিম, অক্ষয়।
সুযোগ পেলেই বড় আপার বাসায় চলে যাই, এবং এই যাওয়াটা যতটানা আপার প্রতি টান, তার-চাইতেও বেশি সম্ভবত কচি কচি কন্ঠের মামা ডাক শোনার আকুলতা এবং আপার হাতের মজাদার রান্না! এবারো ব্যতিক্রম হলোনা, প্রথম বই ( কারাগারের দিনগুলো ) প্রকাশিত হওয়ার পরেই চলে গেলাম আপার বাসায়।
প্রকাশিত বইয়ের প্রথম আট-দশ পাতা পড়ে আওয়ামী সাপোর্টার দুলাভাই নির্লিপ্ত!
বড় ভাগ্নীটা অনুযোগের সুরেই বললো, মামা এগুলা তুমি কি লেখ?
“কেনো মামা, কি হয়েছে?”
“আমার মামা যে একজন লেখক, আমার মামার যে একটা বই বের হয়েছে, এটা আমার বান্ধবীদের কাছে বলতেও পারবোনা, আর কাউকে দেখাতেও পারবোনা। কি সব রাজনৈতিক লেখা লিখছো! রাজনীতি ছাড়া লিখতে পারোনা?”
ভাগ্নে-ভাগ্নীদের কাছে তাদের মামারা হচ্ছেন সুপারম্যান, মামাদের সম্পর্কে বন্ধুদের কাছে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে না পারলে ভাইগ্না-ভাগ্নীদের পেটের ভাত হজম হয়না এটা আমি ভালো করেই বুঝি।
আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলামনা।
ছোট বেলায় বন্ধুদের কাছে গল্প করতাম, “জানো, আমার মামা শিবির করে, মামা শিবিরের বিশাল নেতা, আমার মামার অনেক শক্তি! ঢিশুম! ঢিশুম!
আমার মামার সাথে কেউ তেড়ি বেড়ি করলে মামা তাদের রগ কেটে দেয়। না না, সবার রগ কাটেনা, যারা কান্নাকাটি করে, ক্ষমা চায়, তাদের মাফ করে দেয়। আমার মামা অনেক ভালো!”
ভাগ্নীকে আশ্বস্ত করলাম, আগামী বই মেলায় অরাজনৈতিক গল্পের বই প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহ। তখন তুমি সবাইকে বলতে পারবে, এটা আমার মামার লেখা বই!
ল্যাপটপে কাজ করছিলাম, ক্লাস ওয়ান পড়ুয়া ছোট ভাইগ্না এসে বললো, মামা একটা কথা বলি?
“হ্যা মামা বলো”।
“মামা, কানে কানে বলি?”
কী-বোর্ড টিপতে টিপতেই বললাম, আচ্ছা বলো।
ভাইগ্না কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললো, মামা তুমি কি ডাকাত?
“কেনো মামা, এই প্রশ্ন কেনো?”
“তোমাকে যে পুলিশে নিয়ে গেছে, তুমি যে জেলে ছিলা?!”
বুঝলাম, ভালোই মাইঙ্কার চিপায় পড়েছি, কালকে হয়তো আমার এই ভাইগ্না স্কুলে গিয়ে তার বন্ধুদের সাথে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করবে, “জানো, আমার মামা শিবির করে, মামা মস্ত বড় ডাকাত! সিনেমার নায়কদের মতো করে সুরঙ্গ দিয়ে সোনালি ব্যাঙ্কের সব টাকা ডাকাতি করেছিলো। মামাকে পুলিশে ধরেছিলো, আমার মামার অনেক শক্তি, মামা জেল ভেঙ্গে বেড়িয়ে এসেছে! ঢিশুম! ঢিশুম!”
মনে মনে দোয়া করছিলাম, এমনিতেই উঠতে বসতে আব্বা আমাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করে, এই বই আব্বার হাতে গেলে আমার অবস্থা কেরোসিন!
জোহরের আজান দিতেই ছোট ভাগ্নী জায়নামায নিয়ে হাজির, এখনো কথা বলতে শিখেনাই, আমার হাতে জায়নামায ধরিয়ে দিয়ে বলছে, মাম্মমা ওই নামাজ! মাম্মা, মাম্মা!
“আচ্ছা মামা নামাজ পড়বো, গোসল করে নেই”।
ভাগ্নী কথা শুনতে নারাজ, হৈ চৈ শুরু করে দিলো, এখনই নামায পড়তে হবে। আধো আধো স্বরে মাম্মা, মাম্মা, ডাকছে আর হাত ধরে টানছে।
অগ্যতা উঠে গিয়ে জায়নামায বিছিয়ে দিলাম, ভাগ্নী সরাসরি সিজদায়, সিজদা দিয়ে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখছে! এরপর শুরু হলো ননস্টপ সিজদা, কোনো থামা থামি নাই!
দুপুর বেলা আপা গেলো ভাগ্নিকে ঘুম পাড়াতে, ভাগ্নীকে ঘুম পাড়িয়ে আমার সাথে গল্প করবে। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম সাড়া ঘরময় ভাগ্নীর ছোটাছুটি!
ব্যাপার কি? একটু পরেই বুঝতে পারলাম আসল কাহিনী, ভাগ্নীই বরং আপাকে ঘুম পাড়িয়ে চলে এসেছে!
বিকালে শুরু হলো লুঙ্গি ড্যান্স! ছোট ভাইগ্না টিভিতে “লুঙ্গি ড্যান্স” গান চালু করেছে, আর পিচ্চি ভাগ্নীটা সেই গানের তালে তালে ড্যান্স দিচ্ছে। ভাগ্নীর পড়নে লুঙ্গি নাই, তাই জামাকেই লুঙ্গির মতো ধরে লাফাচ্ছে!
প্রথমে টিভি বন্ধ করে দিলাম, ভাগ্নীর চিৎকার কান্নাকাটিতে কান ঝালাপালা। বাধ্য হয়ে আবার টিভি চালু এবং লুঙ্গি ড্যান্স!
আপাকে ডেকে দেখালাম, বাচ্চারা এগুলো কি শিখছে? ছোট বেলা হতেই অশ্লীলতা দেখে দেখে বড় হলে ভালো খারাপের পার্থক্য করবে কিভাবে?
আপা ঘোষণা দিলেন, এই মাসেই ডিস কানেকশন অফ করে দেয়া হবে। ডিসকানেকশন অফ করে দিলে সমস্যার সমাধান হবেনা, তারচাইতে বরং চ্যানেল চাইল্ড লক করে দিলেই ভালো হয়।
আপার বাসা থেকে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম, ছোট ভাগ্নীটা তখন চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিলো, তার সেই গগন বিদারী চিৎকারে কানে তালা লাগার যোগার, “মামা যাবো, মামা যাবো”।
কোনো রকমে ফাঁকি দিয়ে চলে এলাম।
সব আপন মানুষেরা যদি ছোট ভাগ্নীটার মতো হতো! প্রিয় মানুষের কান্নাও কখনো কখনো দেখতে ইচ্ছে করে।
লেখাঃ আমি একজন মামা
© শামীম রেজা
২৫/০৩/২০১৪
No comments:
Post a Comment