facebook link
বল্টুর সাথে আমার পরিচয় সোহেলের চা দোকানে, প্রায়ই দেখতাম দল বেধে চা খেতে আসতো। কত আর বয়স হবে, সর্বোচ্চ ৮-৯বছর। একদিন পাশে ডেকে বসালাম, জিজ্ঞাসা করলাম নাম কি?
বল্টুর লাজুক জবাব, বল্টু।
হই ব্যাটা, মানুষের নাম বল্টু হয় নাকি!
বল্টু হাসে, ঘাড় বাকিয়ে হাসে, সেই হাসিতে মধু ঝড়েনা, তবে প্রাণ ভরে।
বল্টু আঙুল উচিয়ে অন্যদের দেখায়, ওর নাম ডিব্বা! আরেক জনকে দেখায়, ওর নাম বোতল! বোতলের পাশেই আছে রেঞ্চি, রেঞ্চির পাশের পিচ্চির নাম স্যাম্পল! এবার আমিও হাসি, বল্টু হাঁসে, বল্টুর বন্ধুরাও সেই হাসিতে যোগ দেয়।
এবার কিছুটা সিরিয়াস হওয়ার পালা, বল্টুর আসল নাম কি?
বল্টু একহাত দিয়ে গোল বনের একদিক থেকে খুটে খুটে খায়, আর দুই দিকে ঘাড় নাড়ে, আসল নাম জানিনা!
কেনো জানিস না?
আমার আকিকা দেয়নাই, হেরলেইগা আসল নাম জানিনা।
চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞাসা করলাম, আকিকা কি?
বল্টু লাজুক হাঁসে, আবার ডানে বায়ে মাথা ঝুলায়, জানিনা!
বল্টুদের জীবিকা থাকে বস্তার ভেতরে। আল্লাহ তাদের জন্য বস্তা বরাদ্দ করেছেন। প্রতিদিনই খালি বস্তা হাতে বেরিয়ে পড়ে বল্টুর দল, এখানে সেখানে খুঁজে বেড়ায়, খালি বোতল, বাতিল লোহা, প্লাস্টিক সহ বিভিন্ন বাতিল দ্রব্য। সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহে ফিরে আসে ভাঙ্গারীর দোকানে, বিক্রি করে যা আয় হয়, তাই জমা করে দোকান মালিকের কাছে।
আলীর বাসায় যাওয়ার জন্য প্রায়ই সর্টকাট ওয়ে হিসেবে রেললাইন ব্যবহার করি। বল্টুরা সেখানে বসে থাকে, পলিথিনে গাম রেখে মুখ বন্ধ করে দম নেয়, ঝিমায়। গামের দাম ৮টাকা।
বল্টুদের গামের আড্ডায় একদিন জয়েন করেছিলাম, বল্টু এই গামের নাম কি?
“সল্লিশন গাম”
এইটাতে দম নিলে কি লাভ?
অনেক লাভ আছে, খিদা লাগেনা। যখন বেশি খিদা লাগে, তখন পলিথিনে দম নিয়া পইরা থাকি।
খিদা লাগলে ভাত খাবি, সমস্যা কি?
বল্টু ছল ছল চোখে তাকিয়ে থাকে, টাকা না থাকলে খামু কি? দুই দিন কামে যাইনা, মাল বেচতে পারিনা, জমা টাকা সব মার কাছে দিয়া দিছি।
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা, তোর মা আছে?! তাইলে গ্যারেজে ভ্যানের উপর ঘুমাছ কেনো? তোর মা কই থাকে?
বল্টুর সরল স্বীকারোক্তি, ঘরে সৎ বাবা, বল্টুকে কথায় কথায় মার ধর করে, তাই বল্টু ঘরে থাকেনা। যেদিন বাবা ঘরে থাকেনা সেদিন বল্টু ঘরে গিয়ে মায়ের কাছে ঘুমায়। বল্টু তার উপার্জনের টাকা মায়ের কাছে দিয়ে আসে।
বল্টুকে সেদিন হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো দীর্ঘ দিনের অভুক্ত। গোগ্রাসে গিলছিলো, আর একটু পর পরেই মাথা উচু করে হাসছিলো, নির্মল সেই হাসি, কোটি টাকা মূল্যের হাসি। বল্টুরা দাত মাজেনা, হলদেটে দাতে পোকা ধরেনা, পোকারাও বল্টুদের ভয় পায়, ক্ষুধার জ্বালায় যদি দাতের পোকা খাওয়া শুরু করে!
বল্টুকে শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন ছেলেটি অসুস্থ, প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুরে যাচ্ছে। বল্টুর এক পায়ে কিসের যেনো একটা ক্ষত। সোহেলের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো বল্টু, একদিকে চায়ের কাপে গোল বন ভিজিয়ে বল্টু খায়, অন্যদিকে মাছির দল পায়ের ক্ষত স্থানে বসে বল্টুকে খায়!
আমাকে দেখেই বল্টুর মুখে সে কি হাসি, যেনো পুরানো কোনো বন্ধুকে খুজে পেয়েছে। কিছুটা রকিং মুডেই জিজ্ঞাসা করলাম, হেই বল্টু কি খবর!
সম্ভবত সহানুভূতি পাওয়ার আশাতেই দুঃখী দুঃখী মুখে বল্টু বললো, অনেক জ্বর!
কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম, বল্টুরা ঠিকমতো গোসল করেনা, সারাদিন ময়লা আবর্জনাতে ঘুরে বেড়ায়, গলা সমান নর্দমায় নেমে প্লাস্টিকের বোতল কুড়ায়, বল্টুর ময়লা কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখাটাও একটু কেমন যেনো লাগে।
বল্টুকে খুশি করতেই সম্ভবত, বল্টুর কপালে হাত দিয়ে শিউরে উঠলাম, ভয়াবহ জ্বর!
স্বচ্ছল কোনো পরিবারের সন্তান হলে নির্ঘাত বল্টুর বর্তমান ঠিকানা হতো নামী দামী কোনো হাসপাতালের বেড।
বল্টুদের হাসপাতালের প্রয়োজন হয়না, জ্বর আসে জ্বর চলে যায়, পরাজিত হয় অসুখ, পরাজিত হয় সমাজ, বল্টুরা বেঁচে থাকে, একসময় পরিণত হয় শহরের নাম করা কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী, “টোকাই বল্টু”।
সোহেলের দোকানেই আজ বল্টুর সাথে দেখা, বল্টু এখন সুস্থ, মুঠো ভর্তি টাকা, সম্ভবত গতকাল ভালো বিক্রি হয়েছে। বল্টু একটা জুস কিনলো, একটা কেক দিতে বললো। সোহেল যে কেক দিয়েছে বল্টুর সেটা পছন্দ হয়নাই, বল্টুর দাবী অন্য প্যাকেটের আরেকটা কেক দিতে হবে।
মৃদু ঝাড়ির সুরেই সোহেল বললো, ওইটারতো দাম বেশি ওইটা ক্রিম কেক, এতো দামী কেক তুই খাবি?!
বল্টুও কম যায়না, বল্টু বললো, আমি দামী কেকই নিবো, আজকে আব্বা ঘরে নাই, আমার আম্মায় জুস দিয়া কেক খাইবো, আর আমি বইসা বইসা দেখুম।
বল্টু যে সার্ট গায়ে দিয়েছে সেটার তিনটা বোতাম ছেঁড়া, আর বল্টুর পড়নে যে ফুলপ্যান্ট রয়েছে সেটার হুক নেই, প্লাস্টিকের একটি রশিকেই বেল্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্যান্টের জিপারের জায়গায় একটা সেফটি পিন লাগানো।
বল্টুর একহাতে জুসের বোতল, আরেক হাতে ক্রিম কেক, মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি, চোখে স্বপ্ন, বল্টুর মা জুস দিয়ে কেক খাবে, বল্টু সামনে বসে দেখবে।
গল্পঃ বল্টুর বাবা আজ ঘরে নেই
© শামীম রেজা
১৪/০৩/২০১৪
বল্টুর সাথে আমার পরিচয় সোহেলের চা দোকানে, প্রায়ই দেখতাম দল বেধে চা খেতে আসতো। কত আর বয়স হবে, সর্বোচ্চ ৮-৯বছর। একদিন পাশে ডেকে বসালাম, জিজ্ঞাসা করলাম নাম কি?
বল্টুর লাজুক জবাব, বল্টু।
হই ব্যাটা, মানুষের নাম বল্টু হয় নাকি!
বল্টু হাসে, ঘাড় বাকিয়ে হাসে, সেই হাসিতে মধু ঝড়েনা, তবে প্রাণ ভরে।
বল্টু আঙুল উচিয়ে অন্যদের দেখায়, ওর নাম ডিব্বা! আরেক জনকে দেখায়, ওর নাম বোতল! বোতলের পাশেই আছে রেঞ্চি, রেঞ্চির পাশের পিচ্চির নাম স্যাম্পল! এবার আমিও হাসি, বল্টু হাঁসে, বল্টুর বন্ধুরাও সেই হাসিতে যোগ দেয়।
এবার কিছুটা সিরিয়াস হওয়ার পালা, বল্টুর আসল নাম কি?
বল্টু একহাত দিয়ে গোল বনের একদিক থেকে খুটে খুটে খায়, আর দুই দিকে ঘাড় নাড়ে, আসল নাম জানিনা!
কেনো জানিস না?
আমার আকিকা দেয়নাই, হেরলেইগা আসল নাম জানিনা।
চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞাসা করলাম, আকিকা কি?
বল্টু লাজুক হাঁসে, আবার ডানে বায়ে মাথা ঝুলায়, জানিনা!
বল্টুদের জীবিকা থাকে বস্তার ভেতরে। আল্লাহ তাদের জন্য বস্তা বরাদ্দ করেছেন। প্রতিদিনই খালি বস্তা হাতে বেরিয়ে পড়ে বল্টুর দল, এখানে সেখানে খুঁজে বেড়ায়, খালি বোতল, বাতিল লোহা, প্লাস্টিক সহ বিভিন্ন বাতিল দ্রব্য। সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহে ফিরে আসে ভাঙ্গারীর দোকানে, বিক্রি করে যা আয় হয়, তাই জমা করে দোকান মালিকের কাছে।
আলীর বাসায় যাওয়ার জন্য প্রায়ই সর্টকাট ওয়ে হিসেবে রেললাইন ব্যবহার করি। বল্টুরা সেখানে বসে থাকে, পলিথিনে গাম রেখে মুখ বন্ধ করে দম নেয়, ঝিমায়। গামের দাম ৮টাকা।
বল্টুদের গামের আড্ডায় একদিন জয়েন করেছিলাম, বল্টু এই গামের নাম কি?
“সল্লিশন গাম”
এইটাতে দম নিলে কি লাভ?
অনেক লাভ আছে, খিদা লাগেনা। যখন বেশি খিদা লাগে, তখন পলিথিনে দম নিয়া পইরা থাকি।
খিদা লাগলে ভাত খাবি, সমস্যা কি?
বল্টু ছল ছল চোখে তাকিয়ে থাকে, টাকা না থাকলে খামু কি? দুই দিন কামে যাইনা, মাল বেচতে পারিনা, জমা টাকা সব মার কাছে দিয়া দিছি।
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা, তোর মা আছে?! তাইলে গ্যারেজে ভ্যানের উপর ঘুমাছ কেনো? তোর মা কই থাকে?
বল্টুর সরল স্বীকারোক্তি, ঘরে সৎ বাবা, বল্টুকে কথায় কথায় মার ধর করে, তাই বল্টু ঘরে থাকেনা। যেদিন বাবা ঘরে থাকেনা সেদিন বল্টু ঘরে গিয়ে মায়ের কাছে ঘুমায়। বল্টু তার উপার্জনের টাকা মায়ের কাছে দিয়ে আসে।
বল্টুকে সেদিন হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো দীর্ঘ দিনের অভুক্ত। গোগ্রাসে গিলছিলো, আর একটু পর পরেই মাথা উচু করে হাসছিলো, নির্মল সেই হাসি, কোটি টাকা মূল্যের হাসি। বল্টুরা দাত মাজেনা, হলদেটে দাতে পোকা ধরেনা, পোকারাও বল্টুদের ভয় পায়, ক্ষুধার জ্বালায় যদি দাতের পোকা খাওয়া শুরু করে!
বল্টুকে শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন ছেলেটি অসুস্থ, প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুরে যাচ্ছে। বল্টুর এক পায়ে কিসের যেনো একটা ক্ষত। সোহেলের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো বল্টু, একদিকে চায়ের কাপে গোল বন ভিজিয়ে বল্টু খায়, অন্যদিকে মাছির দল পায়ের ক্ষত স্থানে বসে বল্টুকে খায়!
আমাকে দেখেই বল্টুর মুখে সে কি হাসি, যেনো পুরানো কোনো বন্ধুকে খুজে পেয়েছে। কিছুটা রকিং মুডেই জিজ্ঞাসা করলাম, হেই বল্টু কি খবর!
সম্ভবত সহানুভূতি পাওয়ার আশাতেই দুঃখী দুঃখী মুখে বল্টু বললো, অনেক জ্বর!
কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম, বল্টুরা ঠিকমতো গোসল করেনা, সারাদিন ময়লা আবর্জনাতে ঘুরে বেড়ায়, গলা সমান নর্দমায় নেমে প্লাস্টিকের বোতল কুড়ায়, বল্টুর ময়লা কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখাটাও একটু কেমন যেনো লাগে।
বল্টুকে খুশি করতেই সম্ভবত, বল্টুর কপালে হাত দিয়ে শিউরে উঠলাম, ভয়াবহ জ্বর!
স্বচ্ছল কোনো পরিবারের সন্তান হলে নির্ঘাত বল্টুর বর্তমান ঠিকানা হতো নামী দামী কোনো হাসপাতালের বেড।
বল্টুদের হাসপাতালের প্রয়োজন হয়না, জ্বর আসে জ্বর চলে যায়, পরাজিত হয় অসুখ, পরাজিত হয় সমাজ, বল্টুরা বেঁচে থাকে, একসময় পরিণত হয় শহরের নাম করা কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী, “টোকাই বল্টু”।
সোহেলের দোকানেই আজ বল্টুর সাথে দেখা, বল্টু এখন সুস্থ, মুঠো ভর্তি টাকা, সম্ভবত গতকাল ভালো বিক্রি হয়েছে। বল্টু একটা জুস কিনলো, একটা কেক দিতে বললো। সোহেল যে কেক দিয়েছে বল্টুর সেটা পছন্দ হয়নাই, বল্টুর দাবী অন্য প্যাকেটের আরেকটা কেক দিতে হবে।
মৃদু ঝাড়ির সুরেই সোহেল বললো, ওইটারতো দাম বেশি ওইটা ক্রিম কেক, এতো দামী কেক তুই খাবি?!
বল্টুও কম যায়না, বল্টু বললো, আমি দামী কেকই নিবো, আজকে আব্বা ঘরে নাই, আমার আম্মায় জুস দিয়া কেক খাইবো, আর আমি বইসা বইসা দেখুম।
বল্টু যে সার্ট গায়ে দিয়েছে সেটার তিনটা বোতাম ছেঁড়া, আর বল্টুর পড়নে যে ফুলপ্যান্ট রয়েছে সেটার হুক নেই, প্লাস্টিকের একটি রশিকেই বেল্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্যান্টের জিপারের জায়গায় একটা সেফটি পিন লাগানো।
বল্টুর একহাতে জুসের বোতল, আরেক হাতে ক্রিম কেক, মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি, চোখে স্বপ্ন, বল্টুর মা জুস দিয়ে কেক খাবে, বল্টু সামনে বসে দেখবে।
গল্পঃ বল্টুর বাবা আজ ঘরে নেই
© শামীম রেজা
১৪/০৩/২০১৪
No comments:
Post a Comment