মিডিয়া যুদ্ধ

হলিউড নির্মিত “ফারেনহাইট নাইন ইলেভেন” মুভি দেখেছিলাম। মুসলমানরাযে কতটা খারাপ হতে পারে এই মুভিটি না দেখলে বুঝতে পারতামনা। ফুলের মতো নিস্পাপ মার্কিন সৈন্যরা ইরাকে গিয়েছিলো মানবতার মুক্তির দিশারী হয়ে, বর্বর ইরাকীদের একটু মানবতা শেখাতে, ইরাকের নারীদের ধর্ষণ করে সভ্য সন্তান জন্মানোর এজেন্ডা নিয়ে। কিন্তু এই বর্বর মুসলমানরা মানবতা শিখতে চায়না, তারা মার্কিন সেনাদের উপর গুলি চালায়, আত্মঘাতি বোমা হামলা করে। আহারে কি খারাপ সন্ত্রাসী মুসলমানরা!
এই মুভিটি দেখে মন খারাপ করার কিছু নেই, এই ছবিটি আপনার আমার মতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৈরী করা হয়নাই। মুভিটা বানানো হয়েছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, আপনি আমিতো সন্ত্রাসী নই তাইনা!

মুসলমানরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত, একভাগে আছে যারা কোরানের আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, এরা হচ্ছে সন্ত্রাসী মুসলিম। আরেকভাগে আছে খেয়ে দেয়ে দুই দিন বেঁচে থাকতে চায়, এরা হচ্ছে ভালো মুসলিম, খাঁটি আল্লাহর বান্দা, এরা সকাল বিকাল জিকির আসগার করবে আর মসজিদে সিন্নি দিবে, মরার সাথে সাথেই জান্নাত নিশ্চিত! আসমানের উপর আর জমিনের নিচে ছাড়া এদের আর কোনো চিন্তা নেই। রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরাউন কি নমরুদ এটা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথাও নেই।

গাঁজাতে ইসরাইলী বাহিনীর বর্বরতা নিয়ে একটি লেখা তৈরী করেছিলাম, বার বার চেষ্টা করেও কমেন্ট বক্সে একটি ছবি আপলোড দিতে পারছিলামনা। ছবিটা ছিলো একটি ফিলিস্তিনি শিশুর পোড়া মৃতদেহ। ফেসবুক বার বার একটি ম্যাসেজ শো করছিলো “এই ছবিটা ফেসবুকের পলিসিকে ভায়োলেট করবে, তাই আপলোড করা যাবেনা”। কি অদ্ভুত নিয়ম! যে ফেসবুকে সানি লিওনের মতো পর্ণো তারকার নামে ভেরিফায়েড পেজ থাকতে পারে, যে ফেসবুকে পর্ণো সাহিত্য নিয়ে অশ্লীল পেজ থাকতে পারে, সেখানে ইহুদী বর্বরতা নিয়ে ছবি আপলোড করা যাবেনা, কি অদ্ভুত নিয়ম! নিয়মটা অবশ্যই শুধুমাত্র সন্ত্রাসী মুসলিমদের বিরুদ্ধে এবং এতে আমাদের মাইন্ড করার কিছু নেই। এটা সন্ত্রাসী হামাসের বিরুদ্ধে, আপনি আমিতো ভালো মুসলিম তাইনা!?

কিছুদিন আগে ফেসবুক টুইটার সহ আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে তোলপাড় করা একটি নিউজ ছড়িয়ে পড়লো। যৌন জিহাদ করার জন্য দলে দলে আরব নারীরা সিরিয়াতে যাচ্ছে! কি যুক্তিপূর্ণ উদাহরণ, সচিত্র প্রতিবেদন! শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলো এটা ছিলো ইসলামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রপাগান্ডা।
দলে দলে নারীরা সিরিয়া গমন করেছে এটা ঠিক, তবে সেটা জিহাদ করার জন্য, যৌন জিহাদ নামক অশ্লীল কোনো ব্যাপার এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলোনা।

আপনারা নিশ্চই মালালাকে ভুলে যাননাই, কি আর্তনাদ, কি হাহাকার, পাকিস্থানী এক কিশোরীর জন্য! আমি নিজেও মালালার জন্য শোক প্রকাশ করে দুই মাইল লম্বা লেখা তৈরী করেছিলাম। কি বর্বর তালেবান সন্ত্রাসীরা, একটা কিশোরী মেয়ের উপর হামলা করে, বর্বর, শয়তান, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি আফিয়া সিদ্দিকি সহ অগণিত অগণিত মুসলিম ভাই-বোনদের কথা যার প্রতিদিনই নিহত হচ্ছে মার্কিন ড্রোন হামলায়। আমাদের মন খারাপ করার কিছু নেই, আফিয়া সিদ্দিকীরা আমাদের মতো ভালো মুসলিম ছিলেননা, তিনি ছিলেন সন্ত্রাসী মুসলিম। আজকে ফিলিস্তিনে যে শিশুরা নিহত হচ্ছে, পাকিস্থানের ওয়াজিরিস্থানে যে শিশুরা মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হচ্ছে ওরা সন্ত্রাসী মুসলিম, ওদের জন্য মন খারাপ করার কিছু নেই। মিডিয়া আমাদেরকে বলে দিয়েছে সন্ত্রাসীদের জন্য মন খারাপ করতে হয়না।

বোকো হারামের জিহাদীরা শ’খানেক স্কুল ছাত্রীকে অপহরণ করেছে, বিশ্বব্যাপী মিডিয়াতে তোলপাড় করা নিউজ। স্কুল ছাত্রীদের মুক্তির দাবিতে মিশেল ওবামা ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। মিডিয়াতে নিউজ হলো মেয়ে গুলোকে দাশী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আরো যতসব অশ্লীল কু-রুচি পূর্ণ ইঙ্গিত। ছিঃ ছিঃ বোকো হারামের হারামিরা কতটা খারাপ, তারা মেয়েদেরকে অপহরণ করে।
কিন্তু ভেতরের খবর হচ্ছে সরকারী বাহিনী বোকো হারামের জিহাদীদের পরিবারের সদস্যদেরকে গ্রেপ্তার করে তুমুল অত্যাচার করছিলো। বোকো হারাম এই ছাত্রীদের অপহরণ করেছে বন্দীবিনিময় চুক্তি করার লক্ষে। তোমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছো, আমারও তোমাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছি, ব্যাপারটা এর চাইতে ভিন্ন কিছু নয়। মিডিয়ার এই সত্য গোপন করার মানসিকতাকে আমরা নিন্দা জানাবোনা, কারণ এটা করা হচ্ছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। আপনি আমিতো সন্ত্রাসী নই তাইনা?!

ইরাকে আইএসআইএস অমুসলিমদের উপর মোট আয়ের ২% জিযিয়া ধার্য করেছে, বিনিময়ে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে নিন্দার ঝড়। আহারে ধর্মীয় স্বাধীনতা! বর্বর মুসলিম!
কিন্তু এই মিডিয়াই নিরব থাকে যখন ফ্রান্সের আদালতে মুসলিম নারীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হিজাব পড়ার অপরাধে দুইশত ইউরো জরিমানা করা হয়। এই মিডিয়া ভুলে যায় মুসলিমরা তাদের আয়ের বিশাল একটা অংশ জাকাত প্রদান করে, অমুসলিমরা জাকাত হতে মুক্ত, উপরন্তু তারা জাকাতের মাধ্যমে অর্জিত বিভিন্ন সামাজিক সুবিধা ভোগ করে। না মিডিয়ার এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলবোনা, কারণ আইএসআইএস সন্ত্রাসী সংগঠন। আপনি আমিতো সন্ত্রাসী নই তাইনা!?

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলেম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী হয়ে গেলেন, কুখ্যাত দেলু রাজাকার, শীর্ষস্থানীয় ধর্ষক! বাঙালী বংশোদ্ভুত ইসলামী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা হয়ে গেলেন, বিহারী কসাই কাদের! হত্যা ধর্ষণ নিয়ে মিডিয়াতে রচিত হলো রসালো সাহিত্য কর্ম। না এঘটনায় আমরা মন খারাপ করবোনা, আমরা দুঃখিত হবোনা, কারণ এরা সবাই সন্ত্রাসী মুসলিম, আপনি আমিতো সন্ত্রাসী নই তাইনা?! আমরাতো ভালো মুসলিম, মার্কিন সার্টিফায়েড সভ্য মুসলিম, জান্নাত আমাদের নিশ্চিত!

কথা প্রসঙ্গে এক ভাই বলছিলেন, আজকে ফিলিস্তিনে ইসরাইলী বাহিনী যে হত্যা, ধ্বংশলীলা চালাচ্ছে। এর অর্ধেকও যদি মুসলিমরা করতো তবে বিশ্বব্যাপী কেমন তোলপাড় শুরু হতো! গেলো গেলো করে ইহুদী খৃস্টান মিডিয়া এবং আরব রাজা-বাদশারা তেড়ে আসতোনা? মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘের চোখের পানি নাকের পানি এক হতোনা?!

অনেকেই মনে করছেন আমরা শুধু সামরিক দিক হতে পিছিয়ে আছি, আজকে যদি আমরা অস্ত্র শক্তিতে বলিয়ান হই তবে মুসলিমদের এই সমস্ত সমস্যা থাকবেনা। কিন্তু না, আমরা পিছিয়ে আছি সবগুলো সেক্টরেই, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামরিক, সাংস্কৃতিক, প্রচার মাধ্যম থেকে শুরু করে সবগুলো সেক্টরেই আমরা মার খাচ্ছি।

যুদ্ধাস্ত্রের রুপান্তর ঘটেছে, এখন আর শুধুমাত্র বারুদের মাঝে যুদ্ধাস্ত্র সীমাবদ্ধ নেই। মিডিয়াই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ব। ফিলিস্তিন-ইসরাইলের লড়াইতে মুসলিমরা টুইটার যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছে, আমরা পরিতৃপ্ত্ব, আহ্লাদিত। কিন্তু এই মিডিয়াটিকে আমরা ততদিনই ব্যবহার করতে পারবো যতদিন এর নিয়ন্ত্রকরা আমাদেরকে ব্যবহার করতে দিবে। তারা যখন প্রয়োজন বোধ করবে আমাদের আইডি এবং হ্যাশ ট্যাগগুলো রিমুভ করে দিবে, যেমনি ভাবে আজ বন্ধ করে দেয়া হলো হামাসের সামরিক বিভাগ আল কাসসাম বিগ্রেডের টুইটার একাউন্ট।
প্রয়োজন নিজস্ব মিডিয়া, বিকল্প মিডিয়া।

লেখাঃ মিডিয়া যুদ্ধ
©শামীম রেজা
২০/০৭/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment