এক।
দেশজুড়ে তখন তুমুল আন্দোলন চলছিলো। বিরোধী দলের প্রতি একের পর এক ইস্যু ছুড়ে দিচ্ছে আওয়ামী সরকার। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা সহ অন্যান্য জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আসছিলো একের পর এক মামলার রায়। সাতক্ষিরাতে চলছিলো গণহত্যা। সারাদেশে যেনো শহীদের মিছিল, লাশ, লাশ আর লাশ। চট্টগ্রাম মহানগরীতেও বেশ কয়েকজন ভাই শামীল হলেন সেই শহীদি মিছিলে।
দেশব্যাপী শহীদদের নিয়ে একটি প্রকাশনা তৈরীর লক্ষে আমাকে সহ আরো বেশ কয়েকজন ভাইকে চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিনের শহীদ পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হলো। সাক্ষাৎকার গ্রহনের এক পর্যায়ে পরিচিত হলাম একটি পরিবারের সাথে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুত্রটি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
ছেলেটি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলোনা। শিবিরের মিছিলে পুলিশ গুলি করে, একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় কর্মস্থলে থাকা ছেলেটির শরীরে, সাথে সাথেই সে নিহত হয়।
এই হৃদয় বিদারক ঘটনাটিকে ছাত্রশিবির এড়িয়ে যেতে পারেনাই, পুলিশের গুলিতে নিহত পরিবারের পাশে দাড়ায় ছাত্রশিবির। সংগঠনের পক্ষ থেকে এককালিন বড় অঙ্কের অনুদান এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেয়া হয়। এটা কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ ছিলোনা, যেটা ছিলো সেটা হচ্ছে একটি অসহায় পরিবারের পাশে দাড়ানোর আকুলতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, ছিলোনা কোনো মিডিয়া প্রচারণা।
দুই।
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপরাধ জামায়াত নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবীতে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়েছিলো। হরতাল ডাকার প্রাথমিক যে উদ্দেশ্য থাকে সেটা হচ্ছে, সরকারের অর্থনৈতিক চাকাকে স্তব্ধ করে দেয়া, যার ফলে সরকার বাধ্য হয়ে দাবী মেনে নিবে।
স্বাভাবিকভাবেই সরকার এই হরতাল প্রত্যাক্ষান করলো। আওয়ামী নেতারা হরতালের মধ্যেই তাদের পরিবহন নামিয়ে দিলো, শুরু হলে ব্যাপক ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও।
চট্টগ্রাম মহানগরীতেও সেদিন পিকেটিং চলছিলো। পিকেটিং এর এক পর্যায়ে তাড়াহুড়ো এবং অসাবধানতা বশত ছোট একটি শিশু আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তবে সেটা গুরুতর কিছু ছিলোনা। এক পর্যায়ে পুলিশের এ্যাকশনের কারণে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই।
মানবিক কারণেই দায়িত্বশীলকে ফোন করেছিলাম, বাচ্চাটির কি অবস্থা, কোনো খবর নিয়েছেন কিনা। দায়িত্বশীল যেটা বললেন শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম!
ইতিমধ্যেই তিনি আশে পাশের মানুশের কাছ থেকে বাচ্চাটির পরিবারের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এমনকি পরবর্তীতে শিশুটির ঔষধ খরচ এবং ফলমূল নিয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছেন।
তিন।
ফুটবল মাঠে যখন খেলোয়াড়রা দূর্দান্ত সব পারফর্মেন্স প্রদর্শন করেন, ঠিক তখনি একদল ক্রিয়া বিশেষজ্ঞ এসে হাজির হন টিভি ক্যামেড়ার সামনে। তারা নানা ভাবে বর্ণনা করেন, এভাবে খেলা উচিত হয়নি, ওভাবে খেলা প্রয়োজন ছিলো, সটটা একটু বাঁকা হলে ভালো হতো, এভাবে হেট দেয়া কিছুতেই ঠিক হয়নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি জ্ঞান গর্ভ সব কথাবার্তা। এইসব ক্রিয়া বিশেষজ্ঞকে খেলার মাঠে নামিয়ে দিলেই বোঝা যেতো কত ধানে কত কুড়া।
ঠিক তেমনি ভাবেই জামায়াত যখন সারাদেশে আন্দোলন সংগ্রামে ব্যস্ত তখন একদল জিহাদ বিশেষজ্ঞ এসে ময়দানে হাজির হলেন। না না এভাবে আন্দোলন করা উচিত হচ্ছেনা, অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে। হরতালের নামে এভাবে সাধারণ মানুষের গাড়ি ভাঙা ঠিক হচ্ছেনা, নিরীহ মানুষ হতাহত হচ্ছে। জামায়াততো হারাম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আরে কি হাস্যকর ব্যাপার, জামায়াত তাগুতি আদালতের কাছে ন্যায় বিচার কামনা করে। জামায়াত নিজেও তাগুত হয়ে গেছে, জামায়াত হোয়াইট হাউজে পিটিশন দাখিল করে, জামায়াত নিজেই কুফফার ইত্যাদি ইত্যাদি।
চার।
সেদিন কথা হচ্ছিলো সিরিয়া এবং ইরাক যুদ্ধ নিয়ে, কথা প্রসঙ্গে এক জিহাদ পাগল ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমেরিকার দেয়া অস্ত্র দিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন এটা কি হাস্যকর না?
প্রথমেই সেই ভাইয়ের জবাব, সিরিয়ার যুদ্ধে আইএসআইএস কখনোই আমেরিকা থেকে অস্ত্র নেয়নাই। আর যদি নিয়েও থাকে এটাতো দারুণ একটা কৌশল, আমেরিকার অস্ত্র দিয়ে আমেরিকাকে দমন করা হবে।
আমেরিকার দান করা অস্ত্র দিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা যাবে, কিন্তু ন্যায় বিচারের স্বার্থে হোয়াইট হাউজে পিটিশন দাখিল করা যাবেনা। সুন্দর যুক্তি।
হেকমতের লীজ শুধু মাত্র জিহাদীদের জন্য বরাদ্দ, অন্য কেউ হেকমত অবলম্বন করতে পারবেনা।
পাঁচ।
গণতন্ত্র হারাম! গণতান্ত্রিক পদ্ধতীতে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা।
মিশরে যখন গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসা প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি সরকারের পতন হলো, সেদিন ইহুদি খৃস্টানদের চাইতেও এদেশের জিহাদপন্থীরা এবং নুসরা পন্থীরা অনেক বেশি খুশি হয়েছিলো। তাদের সেসময়কার ফেসবুক স্ট্যাটাসই তাঁর প্রমান।
‘হু দেখলাতো! আগেই বলেছিলাম, গণতন্ত্র দিয়ে ইসলাম হবেনা’।
‘ইসলাম কি দিয়ে হবে?’
‘ইসলাম হবে সুন্নতি পন্থায়, অস্ত্র দিয়ে’।
‘রাসূল (সঃ) এর নেতৃত্বে বিশ্বের প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র গঠন কিভাবে হয়েছিলো, অস্ত্র ক্ষমতাবলে, নাকি ব্যাপক দাওয়াতী কাজ করে জনগনের হৃদয় জয় করে? রাসূল (সঃ) কি মদিনা আক্রমন করে দখল করেছিলেন? তিনি কি অস্ত্রের ক্ষমতাবলে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন?’
এবার আসবে বদর ওহুদ খন্দকের যুদ্ধের প্রসঙ্গ।
‘যুদ্ধ কি খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য হয়েছিলো, নাকি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য করা হয়েছিলো?’
অস্ত্র ক্ষমতাবলে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সুন্নতি পদ্ধতী হইলো কিভাবে? মুরব্বিরা বলেছে এজন্যই এটা সুন্নতি পদ্ধতী?
মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইসলামপন্থী সরকারের পতনে জিহাদপন্থী এবং নুসরাপন্থিরা যতটা খুশি হয়েছিলো।
আফগানিস্থানে সশস্ত্র পন্থায় ক্ষমতা দখল করা তালিবানদের পতনে এই গণতান্ত্রিক ইসলামিস্টরা তাঁর চাইতেও অনেক অনেক গুন বেশি কষ্ট পেয়েছিলো। আমার মনে আছে, আফগানিস্থানে মার্কিন বিমান হামলা শুরু হওয়ার পরে এই জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বেই রাজপথে আমেরিকা বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো। স্কুল পড়ুয়া ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সেই মিছিলে আমিও শরীক হয়েছিলাম।
ছয়।
জামায়াত তাগুতি আদালতের কাছে ন্যায় বিচার কামনা করে, জামায়াত নিজেই তাগুত হয়ে গেছে।
সেদিন খবরে দেখলাম, বাংলাদেশের জিহাদ পন্থীদের আধ্যাত্মিক নেতা, জসিম উদ্দিন রহমানি সাহেব নাকি তাঁর পক্ষে আইনি লড়াই করার জন্য উকিল নিয়োগ দিয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় কারাবন্দী আলেমরা তাদের মুক্তির জন্য আইনি লড়াই চালিয়েছেন এবং এখনো চালাচ্ছেন।
এখনতো মনে হচ্ছে তাগুতি আদালত জিহাদীদের জন্য হালাল, গণতান্ত্রিকদের জন্য হারাম!
সাত।
জামায়াতের হরতালে গাড়ি ভাংচুর করা হয়। জামায়াত খুব খারাপ কাজ করতেছে। জামায়াতের দ্বন্ধ হচ্ছে সরকারের সাথে, সরকারী গাড়ি ভাঙুক, পাবলিক গাড়ি ভাঙবে কেনো।
যুক্তিগুলো অসাধারণ। হরতাল আহ্বান করেও গাড়ি চলতে দিতে হবে।
গতকাল এক জিহাদপন্থী ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম।
//আল্লাহু আকবর, কাবিরা!!
তালিবানের হামলায়, কুফফারদের ৬০০অয়েল ট্যাংকার ধ্বংশ!//
কি সুন্দর খুশির খবর!!
অথচ এই গাড়িগুলোর সবগুলোই ছিলো সাধারণ মানুষের গাড়ি। এর মধ্যে একটাও সরকারী গাড়ি ছিলোনা। এই গাড়িগুলোর অপরাধ ছিলো এরা মার্কিন বাহিনীর রসদ সরবরাহের জন্য ভাড়া খাটতো।
এই তালিবান হামলা এবং গাড়ি ধ্বংশের ব্যাপারটাতে আমিও আনন্দিত। কিন্তু দুঃখ হয় তখনই যখন এদেশের তথাকথিত জিহাদীরা ইসলামী দলের আহুত হরতালের দিন সরকারকে সহযোগীতাকারিদের গাড়ি ভাঙলে হারাম ফতোয়া দেয়। সেই একই জিহাদীরা আফগানিস্থানে সাধারণ মানুষের গাড়ি ধ্বংশ করাতে আনন্দে চিৎকার করে উঠছে।
কৃষ্ণ করলে লীলা খেলা, জামায়াত করলে ঢং।
উপসংহার।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, আপনি কোন মাদ্রাসাকে পছন্দ করেন, কওমী নাকি আলিয়া। তিনি বলেছিলেন, "এটাতো অনেক কঠিন প্রশ্ন, আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি আমার কোন চোখকে বেশি পছন্দ করি বাম চোখ নাকি ডান চোখ। তাহলে কি জবাব দিবো, দুইটাইতো আমার চোখ।"
জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ সহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের নেতাদের বক্তব্য এমনই। তারা গণতান্ত্রিক ইসলামী দল এবং সশস্ত্র ইসলামী দলের উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনা। তারা তালিবানের উপর হামলার নিন্দা জানায়, আবার মিশরের গণতান্ত্রিক সরকারের পতনেও প্রতিবাদ জানায়।
সেদিন আলকায়দা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরী সম্পর্কে পড়লাম, তিনি মিশরের কারাবন্দী প্রেসিডেন্ট মুরসীকে মজলুম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলাদেশের জিহাদপন্থী নামে পরিচিতরা যেখানে সকাল সন্ধ্যা গণতন্ত্র হারাম বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। সেখানে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা, গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্টের নাম সম্মানসূচক ভাবে উচ্চারণ করে বলেছেন প্রেসিডেন্ট মুরসি একজন মজলুম। তাঁর এই বক্তব্য সহনশীলতার জন্য অবশ্যই একটা ভালো দৃষ্টান্ত।
আন্তর্জাতিক জিহাদকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা কখনো বাঁকা চোখে দেখেনাই। ছোট বেলায় শিবিরের প্রকাশিত ম্যাগাজিনে আফগান এবং বসনিয়া চেচনিয়ার মুজাহিদদের নিয়ে লেখাগুলো খুব মনযোগ দিয়ে পড়তাম। এখনো শিবিরের ছেলেরা মুজাহিদদের বিজয়ে উল্লাস প্রকাশ করে, কষ্ট পায় মুজাহিদদের পরাজয়ে।
যদি কখনো আন্তর্জাতিক জিহাদের প্রতি জামায়াত শিবিরের সাধারণ কর্মীদের মনে বিরুপ কোনো ধারণা জন্মে থাকে, তবে এটার জন্য আমি এদেশের তথাকথিত জিহাদপন্থী নামক পরিচিত উজবুকদের লাগামহীন বাড়াবাড়িকেই দায়ী করবো।
লেখাঃ গ্লোবাল জিহাদ ও জামায়াত
© শামীম রেজা
০৭/০৭/২০১৪
দেশজুড়ে তখন তুমুল আন্দোলন চলছিলো। বিরোধী দলের প্রতি একের পর এক ইস্যু ছুড়ে দিচ্ছে আওয়ামী সরকার। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা সহ অন্যান্য জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আসছিলো একের পর এক মামলার রায়। সাতক্ষিরাতে চলছিলো গণহত্যা। সারাদেশে যেনো শহীদের মিছিল, লাশ, লাশ আর লাশ। চট্টগ্রাম মহানগরীতেও বেশ কয়েকজন ভাই শামীল হলেন সেই শহীদি মিছিলে।
দেশব্যাপী শহীদদের নিয়ে একটি প্রকাশনা তৈরীর লক্ষে আমাকে সহ আরো বেশ কয়েকজন ভাইকে চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিনের শহীদ পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হলো। সাক্ষাৎকার গ্রহনের এক পর্যায়ে পরিচিত হলাম একটি পরিবারের সাথে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুত্রটি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
ছেলেটি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলোনা। শিবিরের মিছিলে পুলিশ গুলি করে, একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় কর্মস্থলে থাকা ছেলেটির শরীরে, সাথে সাথেই সে নিহত হয়।
এই হৃদয় বিদারক ঘটনাটিকে ছাত্রশিবির এড়িয়ে যেতে পারেনাই, পুলিশের গুলিতে নিহত পরিবারের পাশে দাড়ায় ছাত্রশিবির। সংগঠনের পক্ষ থেকে এককালিন বড় অঙ্কের অনুদান এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেয়া হয়। এটা কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ ছিলোনা, যেটা ছিলো সেটা হচ্ছে একটি অসহায় পরিবারের পাশে দাড়ানোর আকুলতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, ছিলোনা কোনো মিডিয়া প্রচারণা।
দুই।
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপরাধ জামায়াত নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবীতে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়েছিলো। হরতাল ডাকার প্রাথমিক যে উদ্দেশ্য থাকে সেটা হচ্ছে, সরকারের অর্থনৈতিক চাকাকে স্তব্ধ করে দেয়া, যার ফলে সরকার বাধ্য হয়ে দাবী মেনে নিবে।
স্বাভাবিকভাবেই সরকার এই হরতাল প্রত্যাক্ষান করলো। আওয়ামী নেতারা হরতালের মধ্যেই তাদের পরিবহন নামিয়ে দিলো, শুরু হলে ব্যাপক ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও।
চট্টগ্রাম মহানগরীতেও সেদিন পিকেটিং চলছিলো। পিকেটিং এর এক পর্যায়ে তাড়াহুড়ো এবং অসাবধানতা বশত ছোট একটি শিশু আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তবে সেটা গুরুতর কিছু ছিলোনা। এক পর্যায়ে পুলিশের এ্যাকশনের কারণে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই।
মানবিক কারণেই দায়িত্বশীলকে ফোন করেছিলাম, বাচ্চাটির কি অবস্থা, কোনো খবর নিয়েছেন কিনা। দায়িত্বশীল যেটা বললেন শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম!
ইতিমধ্যেই তিনি আশে পাশের মানুশের কাছ থেকে বাচ্চাটির পরিবারের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এমনকি পরবর্তীতে শিশুটির ঔষধ খরচ এবং ফলমূল নিয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছেন।
তিন।
ফুটবল মাঠে যখন খেলোয়াড়রা দূর্দান্ত সব পারফর্মেন্স প্রদর্শন করেন, ঠিক তখনি একদল ক্রিয়া বিশেষজ্ঞ এসে হাজির হন টিভি ক্যামেড়ার সামনে। তারা নানা ভাবে বর্ণনা করেন, এভাবে খেলা উচিত হয়নি, ওভাবে খেলা প্রয়োজন ছিলো, সটটা একটু বাঁকা হলে ভালো হতো, এভাবে হেট দেয়া কিছুতেই ঠিক হয়নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি জ্ঞান গর্ভ সব কথাবার্তা। এইসব ক্রিয়া বিশেষজ্ঞকে খেলার মাঠে নামিয়ে দিলেই বোঝা যেতো কত ধানে কত কুড়া।
ঠিক তেমনি ভাবেই জামায়াত যখন সারাদেশে আন্দোলন সংগ্রামে ব্যস্ত তখন একদল জিহাদ বিশেষজ্ঞ এসে ময়দানে হাজির হলেন। না না এভাবে আন্দোলন করা উচিত হচ্ছেনা, অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে। হরতালের নামে এভাবে সাধারণ মানুষের গাড়ি ভাঙা ঠিক হচ্ছেনা, নিরীহ মানুষ হতাহত হচ্ছে। জামায়াততো হারাম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আরে কি হাস্যকর ব্যাপার, জামায়াত তাগুতি আদালতের কাছে ন্যায় বিচার কামনা করে। জামায়াত নিজেও তাগুত হয়ে গেছে, জামায়াত হোয়াইট হাউজে পিটিশন দাখিল করে, জামায়াত নিজেই কুফফার ইত্যাদি ইত্যাদি।
চার।
সেদিন কথা হচ্ছিলো সিরিয়া এবং ইরাক যুদ্ধ নিয়ে, কথা প্রসঙ্গে এক জিহাদ পাগল ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমেরিকার দেয়া অস্ত্র দিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন এটা কি হাস্যকর না?
প্রথমেই সেই ভাইয়ের জবাব, সিরিয়ার যুদ্ধে আইএসআইএস কখনোই আমেরিকা থেকে অস্ত্র নেয়নাই। আর যদি নিয়েও থাকে এটাতো দারুণ একটা কৌশল, আমেরিকার অস্ত্র দিয়ে আমেরিকাকে দমন করা হবে।
আমেরিকার দান করা অস্ত্র দিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা যাবে, কিন্তু ন্যায় বিচারের স্বার্থে হোয়াইট হাউজে পিটিশন দাখিল করা যাবেনা। সুন্দর যুক্তি।
হেকমতের লীজ শুধু মাত্র জিহাদীদের জন্য বরাদ্দ, অন্য কেউ হেকমত অবলম্বন করতে পারবেনা।
পাঁচ।
গণতন্ত্র হারাম! গণতান্ত্রিক পদ্ধতীতে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা।
মিশরে যখন গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসা প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি সরকারের পতন হলো, সেদিন ইহুদি খৃস্টানদের চাইতেও এদেশের জিহাদপন্থীরা এবং নুসরা পন্থীরা অনেক বেশি খুশি হয়েছিলো। তাদের সেসময়কার ফেসবুক স্ট্যাটাসই তাঁর প্রমান।
‘হু দেখলাতো! আগেই বলেছিলাম, গণতন্ত্র দিয়ে ইসলাম হবেনা’।
‘ইসলাম কি দিয়ে হবে?’
‘ইসলাম হবে সুন্নতি পন্থায়, অস্ত্র দিয়ে’।
‘রাসূল (সঃ) এর নেতৃত্বে বিশ্বের প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র গঠন কিভাবে হয়েছিলো, অস্ত্র ক্ষমতাবলে, নাকি ব্যাপক দাওয়াতী কাজ করে জনগনের হৃদয় জয় করে? রাসূল (সঃ) কি মদিনা আক্রমন করে দখল করেছিলেন? তিনি কি অস্ত্রের ক্ষমতাবলে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন?’
এবার আসবে বদর ওহুদ খন্দকের যুদ্ধের প্রসঙ্গ।
‘যুদ্ধ কি খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য হয়েছিলো, নাকি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য করা হয়েছিলো?’
অস্ত্র ক্ষমতাবলে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সুন্নতি পদ্ধতী হইলো কিভাবে? মুরব্বিরা বলেছে এজন্যই এটা সুন্নতি পদ্ধতী?
মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইসলামপন্থী সরকারের পতনে জিহাদপন্থী এবং নুসরাপন্থিরা যতটা খুশি হয়েছিলো।
আফগানিস্থানে সশস্ত্র পন্থায় ক্ষমতা দখল করা তালিবানদের পতনে এই গণতান্ত্রিক ইসলামিস্টরা তাঁর চাইতেও অনেক অনেক গুন বেশি কষ্ট পেয়েছিলো। আমার মনে আছে, আফগানিস্থানে মার্কিন বিমান হামলা শুরু হওয়ার পরে এই জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বেই রাজপথে আমেরিকা বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো। স্কুল পড়ুয়া ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সেই মিছিলে আমিও শরীক হয়েছিলাম।
ছয়।
জামায়াত তাগুতি আদালতের কাছে ন্যায় বিচার কামনা করে, জামায়াত নিজেই তাগুত হয়ে গেছে।
সেদিন খবরে দেখলাম, বাংলাদেশের জিহাদ পন্থীদের আধ্যাত্মিক নেতা, জসিম উদ্দিন রহমানি সাহেব নাকি তাঁর পক্ষে আইনি লড়াই করার জন্য উকিল নিয়োগ দিয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় কারাবন্দী আলেমরা তাদের মুক্তির জন্য আইনি লড়াই চালিয়েছেন এবং এখনো চালাচ্ছেন।
এখনতো মনে হচ্ছে তাগুতি আদালত জিহাদীদের জন্য হালাল, গণতান্ত্রিকদের জন্য হারাম!
সাত।
জামায়াতের হরতালে গাড়ি ভাংচুর করা হয়। জামায়াত খুব খারাপ কাজ করতেছে। জামায়াতের দ্বন্ধ হচ্ছে সরকারের সাথে, সরকারী গাড়ি ভাঙুক, পাবলিক গাড়ি ভাঙবে কেনো।
যুক্তিগুলো অসাধারণ। হরতাল আহ্বান করেও গাড়ি চলতে দিতে হবে।
গতকাল এক জিহাদপন্থী ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম।
//আল্লাহু আকবর, কাবিরা!!
তালিবানের হামলায়, কুফফারদের ৬০০অয়েল ট্যাংকার ধ্বংশ!//
কি সুন্দর খুশির খবর!!
অথচ এই গাড়িগুলোর সবগুলোই ছিলো সাধারণ মানুষের গাড়ি। এর মধ্যে একটাও সরকারী গাড়ি ছিলোনা। এই গাড়িগুলোর অপরাধ ছিলো এরা মার্কিন বাহিনীর রসদ সরবরাহের জন্য ভাড়া খাটতো।
এই তালিবান হামলা এবং গাড়ি ধ্বংশের ব্যাপারটাতে আমিও আনন্দিত। কিন্তু দুঃখ হয় তখনই যখন এদেশের তথাকথিত জিহাদীরা ইসলামী দলের আহুত হরতালের দিন সরকারকে সহযোগীতাকারিদের গাড়ি ভাঙলে হারাম ফতোয়া দেয়। সেই একই জিহাদীরা আফগানিস্থানে সাধারণ মানুষের গাড়ি ধ্বংশ করাতে আনন্দে চিৎকার করে উঠছে।
কৃষ্ণ করলে লীলা খেলা, জামায়াত করলে ঢং।
উপসংহার।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, আপনি কোন মাদ্রাসাকে পছন্দ করেন, কওমী নাকি আলিয়া। তিনি বলেছিলেন, "এটাতো অনেক কঠিন প্রশ্ন, আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি আমার কোন চোখকে বেশি পছন্দ করি বাম চোখ নাকি ডান চোখ। তাহলে কি জবাব দিবো, দুইটাইতো আমার চোখ।"
জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ সহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের নেতাদের বক্তব্য এমনই। তারা গণতান্ত্রিক ইসলামী দল এবং সশস্ত্র ইসলামী দলের উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনা। তারা তালিবানের উপর হামলার নিন্দা জানায়, আবার মিশরের গণতান্ত্রিক সরকারের পতনেও প্রতিবাদ জানায়।
সেদিন আলকায়দা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরী সম্পর্কে পড়লাম, তিনি মিশরের কারাবন্দী প্রেসিডেন্ট মুরসীকে মজলুম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলাদেশের জিহাদপন্থী নামে পরিচিতরা যেখানে সকাল সন্ধ্যা গণতন্ত্র হারাম বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। সেখানে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা, গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্টের নাম সম্মানসূচক ভাবে উচ্চারণ করে বলেছেন প্রেসিডেন্ট মুরসি একজন মজলুম। তাঁর এই বক্তব্য সহনশীলতার জন্য অবশ্যই একটা ভালো দৃষ্টান্ত।
আন্তর্জাতিক জিহাদকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা কখনো বাঁকা চোখে দেখেনাই। ছোট বেলায় শিবিরের প্রকাশিত ম্যাগাজিনে আফগান এবং বসনিয়া চেচনিয়ার মুজাহিদদের নিয়ে লেখাগুলো খুব মনযোগ দিয়ে পড়তাম। এখনো শিবিরের ছেলেরা মুজাহিদদের বিজয়ে উল্লাস প্রকাশ করে, কষ্ট পায় মুজাহিদদের পরাজয়ে।
যদি কখনো আন্তর্জাতিক জিহাদের প্রতি জামায়াত শিবিরের সাধারণ কর্মীদের মনে বিরুপ কোনো ধারণা জন্মে থাকে, তবে এটার জন্য আমি এদেশের তথাকথিত জিহাদপন্থী নামক পরিচিত উজবুকদের লাগামহীন বাড়াবাড়িকেই দায়ী করবো।
লেখাঃ গ্লোবাল জিহাদ ও জামায়াত
© শামীম রেজা
০৭/০৭/২০১৪
No comments:
Post a Comment