অবিবেচক

আমার রুমমেট আমিন ভাই অত্যান্ত অমায়িক মানুষ, মানুষের বিপদের কথা শুনলেই ছুটে যান, ঝাপিয়ে পড়েন বিপদাপন্ন মানুষের সেবায়।

হঠাৎ করেই ইউনিভার্সিটির এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান জরুরী অপারেশন করতে হবে আশি হাজার টাকা প্রয়োজন, নইলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা। এদিকে রোগীর আর্থিক অবস্থা চরম পর্যায়ের অসহায়। হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলো রোগী।
আমিন ভাই ডাক্তারকে বললেন, “আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করেন, আমি টাকার ব্যবস্থা করছি”। এদিকে আমিন ভাইয়ের পকেটে ফুটো পয়সাও নেই, ছুটে গেলেন চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে, বন্ধুদের জড়ো করে গঠন করা হলো ফান্ড, ছাত্রদের থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে অপারেশনের টাকা পরিশোধ করা হলো।

গ্রামের অসহায় এক দরিদ্র পিতা, অসুস্থতা জনিত কারনে ভর্তি করা হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রোগীর অপারেশন হবে, প্রয়োজন ৩ব্যাগ রক্তের। ছুটে গেলেন আমিন ভাই, অনাত্মীয় এক মানুষের জন্য সংগ্রহ করে দিলেন তিন ব্যাগ রক্ত।
তারই কিছুদিন পরে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত এক শিশুর রক্তের প্রয়োজন, ফেসবুকে পোস্ট দেখে হাজির হলেন আমিন ভাই। ব্যবস্থা করা হলো রক্ত।
পরোপকারী এই মানুষটার রক্তের সাথে মিশে আছে মানুষের উপকার করা। তাই যেখানেই মানুষের দূর্দশার কথা শুনেছেন ছুটে গেছেন বিপদাক্রান্ত মানুষের পাশে।

যে ঘটনার প্রেক্ষিতে আজকের এই পোস্ট সেটা এখন উল্লেখ করবো। জরুরী রক্তের প্রয়োজন জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট শেয়ার দিলাম, পাশে তাকিয়ে দেখি আমিন ভাই হাজির, জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাচ্ছেন?
আমিন ভাইয়ের নির্লিপ্ত জবাব, রক্ত দিতে।

আমিন ভাই ছুটে গেলেন, ন্যাশনাল হাসপাতালে।
রোগির ছয় ছেলের মধ্যে দুই ছেলে উপস্থিত, বড় ছেলে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন, এবং চট্টগ্রাম ইউনিতে পিএইচডি অধ্যায়নরত। আর ছোট জন আইইউসিতে ইংলিশে মাস্টার্স করছেন। কথা, বেশ ভূষায় বোঝা যাচ্ছে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবার।

ছোট ছেলের সাথে কথা প্রসঙ্গে আমিন ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, সংগঠন (জামায়াত-শিবির) করেন?
তার নির্লিপ্ত জবাব, “না করিনা, তবে আমার ছোট ভাই করতো এখন আর করেনা”।
হতাশ আমিন ভাই আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেননা।
তারপরে সেই ছোট ছেলের ফিসফিস করে প্রশ্ন, “আপনি যে রক্ত দিতে আসছেন, আপনার কোনো দাবী আছে?”
হতভম্ব আমিন ভাই বললেন, কিসের দাবী?
“না, অনেকেইতো রক্ত দিয়ে টাকা পয়সা চায়!”
আমিন ভাই জানালেন তার কোনো দাবী নেই।

ন্যাশনাল হাসপাতালের নিজস্ব ব্লাড ব্যাংক নেই, রক্ত দিতে হবে আন্দরকিল্লা রেডক্রিসেন্টে গিয়ে। সিএনজিতে উঠেই ছোট ছেলে কথা বলা শুরু করলো। “রক্ত আমিই দিতাম, কিন্তু বড় ভাই নিষেধ করলো, রক্ত দেয়ার পরে যদি কিছু হয়ে যায় তবে আব্বার সেবা করবে কে, তাই দিচ্ছিনা!!!”
এবার বিরক্ত হওয়ার পালা, রোগীর ছোট ছেলের বিশাল শরীরের দিকে তাকিয়ে আমিন ভাইয়ের মেজাজ সপ্তমে। এটা কেমন কথা, বাবার সাথে ব্লাড গ্রুপ মিল থাকার পরেও ছেলে রক্ত দিচ্ছেনা, এরা কেমন লোক?! একবার ভাবলেন রক্ত না দিয়েই চলে আসবেন, কিন্তু মুখের সামনে এভাবে কাউকে অপমান করতেও ইচ্ছে হচ্ছিলোনা।

রক্ত দিয়ে ফিরে আসার পথে সিএনজি নেয়া হলো, আন্দরকিল্লা হতে খুলশী। রোগীর ছেলেই দরদাম করে সিএনজি নিলেন, নইলে আমিন ভাই হয়তো ৫টাকা দিয়ে টেম্পুতে বাদুর ঝোলা হয়ে বাসায় আসতেন। সিএনজি ভাড়া একশ বিশ টাকা। পথিমধ্যে ন্যাশনাল হাসপাতালের কাছাকাছি এসে রক্তের ব্যাগ নিয়ে রোগীর ছেলে নেমে গেলো।

অত্যান্ত বিব্রতকর হলেও ব্যাপারটা সত্যি যে, রোগীর ছেলে সিএনজি ভাড়াটা দেননি, আমিন ভাই বাসায় এসে সিএনজি ভাড়া পরিশোধ করেছেন।
আমিন ভাই আক্ষেপ করে বলছিলেন, “রোগী যদি দরিদ্র হতেন তবে কিছু টাকা দিয়ে আসতাম, কিন্তু এমন স্বচ্ছল একটা পরিবারের কাছ থেকে এমন আচরণ দেখে আমি হতাশ!”


লেখাঃ অবিবেচক 
© শামীম রেজা
 ১৬/০৭/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment