মসজিদ নয়, মুসল্লি নির্মাণ করুন।

রেল গেইটের কাছেই মূল রাস্তার পাশে স্থাপন করা হয়েছে স্থায়ী টং ঘর, লাগানো হয়েছে স্থায়ী মাইক। সেই ভোর বেলায় যখন মানুষ রাস্তার পাশ দিয়ে গার্মেন্টসে-অফিসে যাতায়াত করে অর্থাৎ ৭টা থেকে শুরু হয় সুরেলা কন্ঠের আহ্বান- “কত টাকা কত পয়সা অকারণে চলে যায়, আল্লাহর ঘরে দান করিলে আখেরাতে পাওয়া যায়...”

এই টংঘরটিতে মসজিদের টাকা তোলা হচ্ছে বিগত চার-পাচ বছর ধরে, আপাতত দৃষ্টিতে মহৎ এই কর্মটি দেখে অনেক ভাইয়ের হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়, আহা মসজিদের জন্য কত দরদ, সংসার মায়া ত্যাগ করে কতিপয় মানুষ সেই ভোর হতে মধ্যরাত পর্যন্ত মসজিদের জন্য টাকা তুলেই যাচ্ছে, রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বন্যা তাদের এই কাজে বাঁধা প্রদান করতে পারছেনা, মাশাআল্লাহ।

এলাকার কিছু মুরব্বি এবং তরুণ প্রায়ই কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলো, ভাই একটা কিছু করেন, সেই ভোর বেলা থেকে শুরু হয় এদের অত্যাচার, ঘরে অসুস্থ মানুষ আছে, বাচ্চারা ঘুমাতে পারেনা, পরীক্ষার্থীরা পড়তে পারেনা। আল্লাহর তিরিশটা দিন যদি এভাবে কানের কাছে মাইকের প্যান প্যানানী চলতে থাকে তাহলে ঘরে কেমন থাকি? মসজিদের জন্য এভাবে মাইক বাজিয়ে টাকা তুলে মানুষকে কষ্ট দেয়া কি ইসলামের বিধান?

প্রথমে ভাবলাম সাংগঠনিক উদ্যোগে এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে টংঘরটা ভেঙে দেই। পরবর্তীতে পিছিয়ে এলাম, এমনিতেই জামায়াত শিবিরের দোষের অভাব নেই, এই ঘটনার পরে দেখা যাবে পত্রিকায় বড় বড় হেডিং-এ নিউজ আসবে, “মসজিদের উন্নয়নের জন্য টাকা কালেকশনে শিবিরের বাঁধা!” চারিদিকে ছিঃ ছিঃ পরে যাবে। জামায়াত শিবির এতো খারাপ! মসজিদের উন্নয়নে বাঁধা প্রদান করে! কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে নিউজ করবে “জামায়াত শিবিরের বাধায় মসজিদ বানানো সম্ভব হলোনা”।

টংঘরটি এখনো আছে, এখনো মাইক বাজিয়ে টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। দান সংগ্রহকারীদের সাথে মসজিদ কমিটির চুক্তি আছে, দানের দুই তৃতীয়াংশ পাবে দান সংগ্রহকারীরা আর একভাগ পাবে মসজিদ।

প্রায়ই ব্যক্তিগত-পারিবারিক কাজে দেশের এমাথা ওমাথা ভ্রমণ করতে হয়। গাড়িতে উঠতেই ধারাবাহিকভাবে একের পর এক আসতে থাকে, কেউ আসে স্রেফ ভিক্ষার জন্য তাদেরকে কাউকে দেই, কাউকে দেইনা। আরেক শ্রেণির মানুষ আসে, মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্রাসা ইত্যাদির জন্য।

মাওয়া পয়েন্টে নৌ পারাপারের সময় একটি কওমী মাদ্রাসায় দানের জন্য লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছিলো। মাদ্রাসার লিফলেটটি পড়তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ডাক দিয়ে বললাম, হাফেজদেরকে কি সুদের টাকা খাওয়াবেন?
মাদ্রাসার একাউন্ট করা হয়েছে সোনালী ব্যাংকে। কোনো সদুত্তর নেই!
আমার দেখা অধিকাংশ কওমী মাদ্রাসার লেনদেন সুদী ব্যাংকের সাথে। ইসলামী ব্যাংক জামায়াতী প্রতিষ্ঠান, তাই তারা ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করেনা।

ফেনীর মহিপাল বাসস্ট্যান্ডে প্রায়ই এতিমখানার ছেলেরা টাকা কালেকশন করতে আসে। টাকা দেয়ার সাথে সাথেই বলে, “ভাইয়া আমার একটা কোরআন শরীফ কেনা লাগবে যদি একটা কোরআন কেনার টাকা দিতেন!” প্রথম প্রথম দিতাম, এখন দেইনা, কেমন যেনো সন্দেহ হয়।
মহিপাল বাসস্ট্যান্ডে আরেকটা ছেলে রেগুলার টাকা কালেকশন করে, সিলমারা চেহারা, একবার দেখলেই আজীবন মনে থাকে। সম্ভবত গাঁজা খায়! অতিরিক্ত সিগারেট খাওয়ার কারনে ঠোট দুটি পুড়ে কালো হয়ে গেছে। একহাতে মসজিদের চাঁদার রসিদ হাতে নিয়ে টাকা সংগ্রহ করছে।

ঈদের পর পর একটা বিয়ের দাওয়াত ছিলো মানিকগঞ্জের সারারিয়া গ্রামে। ব্যস্ততার কারনে যাওয়া হয়নাই। খালাতো ভাই গিয়েছিলো, এর আগেও বেশ কয়েকবার সে ওই এলাকা ঘুরে এসেছে। তার কাছ থেকেই শুনলাম, প্রতি পাঁচ মিনিট হাটা পথ অতিক্রম করলেই একটা করে মসজিদ, যে সে মসজিদ নয় অত্যান্ত জাকজমকপূর্ণ ভাবে টাইলস করা মসজিদ, প্রবাসীরা তাদের আয় দিয়ে এইসব মসজিদ স্থাপন করেছেন।
সব চাইতে হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে এতো সুন্দর সুন্দর মসজিদ অথচ নামাজ আদায় করার মতো মুসল্লি নেই।
আজান দিয়ে ঈমাম সাহেব বসে আছেন, মসজিদের পাশ দিয়ে এক লোক হেটে যাচ্ছে। ঈমাম সাহেব ডাক দিয়ে বললেন, ভাই নামাজ পড়বেননা?
হুজুর আপনি শুরু করে দেন, আমার কাজ আছে!

সে গ্রামের আরেকটি ভয়াবহ রীতির কথা শুনলাম, জানিনা সমগ্র মানিকগঞ্জে একই রীতি চালু আছে কিনা। সেটা হচ্ছে, বিয়ের অনুষ্ঠানে কনে এবং কনের সকল নারী অভিভাবক মা, চাচী, খালা, ফুফু কপালে সিঁদুর ধারণ করেন। মুসলিমের বিয়েতে হিন্দুয়ানী প্রথা। এমনকি ধান, দূর্বাঘাস, ইত্যাদি দিয়ে লক্ষীপূজার আদলে কিছু প্রথা বাস্তবায়ন করা হয়।

একই সাথে অনেকগুলো ব্যাপার উপস্থাপন করলাম, এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে উলু বনে মুক্ত ছড়ানো হতে মুসলমানদের বিরত রাখা। মসজিদ সংস্কারে অর্থ ব্যায় না করে মুসল্লি সংস্কারে অর্থ ব্যায় করা।
প্রতি মাসের আয়ের একটা অংশ পৃথক করে রাখুন দান করার উদ্দেশ্যে এবং পথে ঘাটে মসজিদ মাদ্রাসায় দান না করে সরাসরি মাদ্রাসাতে গিয়ে টাকা দান করুন। আমার মতে পথে-ঘাটের মসজিদের জন্য টাকা দান করার প্রয়োজন নেই, মসজিদ সংস্কারের প্রয়োজন হলে স্থানীয় মুসল্লিরাই সেটার ব্যবস্থা করবে। আপনি বরং মুসল্লি তৈরীর জন্য টাকা ব্যায় করুন।

বাংলাদেশের মানুষের ইসলাম বোঝার মধ্যে এখনো শিরকী চিন্তা ভাবনা রয়ে গেছে। বাজেটের একটা অংশ দিয়ে ইসলামী বই কিনুন, সেই বই উপহার দিন প্রিয়জনকে।
আপনার দেয়া বই পড়ে তৈরি হবে মুসল্লি, এই মুসল্লিরাই তৈরী করবে মসজিদ, মাদ্রাসা।
অবশ্যই অবশ্যই সরাসরি মাদ্রাসাতে দান করতে হবে। ডাক্তার তৈরীতে যেমন মেডিকেল কলেজের বিকল্প নেই, আলেম তৈরীতে তেমনি মাদ্রাসার বিকল্প কিছু নেই।

সারারিয়ার মতো মুসল্লি বিহীন সুরম্য মসজিদ বানিয়ে কি লাভ হবে? তার চাইতে মসজিদ বিহীন উন্মুক্ত ময়দানে তিনজন মানুষের নামাজের জামায়াত অনেক বেশি উত্তম।

লেখাঃ মসজিদ নয়, মুসল্লি নির্মাণ করুন।
© শামীম রেজা
১৫/০৮/২০১৪

Post Comment

No comments:

Post a Comment